বাগেরহাট

উপকূলে পানির হাহাকার

অনাবৃষ্টি ও খরার কারণে সুপেয় পানির পুকুরগুলো শুকিয়ে গেছে। খাওয়ার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।

অনাবৃষ্টি ও খরায় মোরেলগঞ্জের বেশির ভাগ পুকুর শুকিয়ে গেছে। ভাষান্দল বিশারীঘাটা বাইতুল মামুন মসজিদসংলগ্ন পুকুর থেকে সবাই খাওয়ার পানি নেন
  ছবি: সাদ্দাম হোসেন

ছোট্ট মরিয়ামের ডান হাতের কবজিতে ক্যানুলা বসানো। দেড় বছরের শিশুটি দুদিন পর উঠে দাঁড়াতে পারছে। তবে মুখে নিতে চাইছে না কিছুই। ডাবের পানি গ্লাসে নিয়ে তাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন মা। ফের কাঁদতে শুরু করেছে মরিয়াম। ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে দুই দিন ধরে বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি শিশুটি।

মরিয়ামদের বাড়ি শরণখোলা উপজেলার সোনাতলা গ্রামে। গত কয়েক দিনে ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে নানা বয়সী রোগী এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হয়েছে। ১ থেকে ২৭ এপ্রিল কেবল ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিয়েছে পাঁচ শতাধিক মানুষ। যার মধ্যে ভর্তি করতে হয়েছে ২৩৮ জনকে। চিকিৎসকেরা বলছেন, বিশুদ্ধ পানির সংকটের কারণেই ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে।

স্থানীয় লোকজন বলছেন, প্রায় ছয় মাস অনাবৃষ্টি ও খরার কারণে সুপেয় পানির পুকুরগুলো শুকিয়ে গেছে। খাওয়ার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে উপজেলাজুড়ে। কোনো কোনো এলাকায় খাবার থেকেও দৈনন্দিন বিভিন্ন কাজে ব্যবহার্য পানির সংকট আরও তীব্র।

শরণখোলা ছাড়াও একই অবস্থা বাগেরহাটের উপকূলীয় উপজেলা মোরেলগঞ্জ, মোংলা ও রামপালে। এসব উপজেলার প্রায় সাড়ে সাত লাখ মানুষ সুপেয় পানির সংকটে রয়েছে। অধিকাংশ এলাকায় নলকূপ ও গভীর নলকূপ অকার্যকর হয়ে গেছে। নদী-খালের মতো নলকূপের পানিতে লবণাক্ততার কারণে লোকজন সেখানে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে রাখেন খাবার জন্য। সেই পানি ফুরিয়েছে দুই-তিন মাস হলো। এরপর পুকুরের পানিই ভরসা। দীর্ঘ অনাবৃষ্টিতে শুকিয়ে গেছে অধিকাংশ পুকুর। খাওয়ার পানি সংগ্রহের জন্য কয়েক কিলোমিটার পাড়ি দিতে হচ্ছে অনেক পরিবারকে।

মোরেলগঞ্জের আশপাশের প্রায় পাঁচ বর্গকিলোমিটার এলাকার মানুষের খাবার পানির উৎস ভাষান্দল বিশারীঘাটা বায়তুল মামুন মসজিদসংলগ্ন পুকুরটি। পানি নিতে আসা পাশের পশ্চিম সরালিয়া গ্রামের কামরুজ্জামান মনির বলেন, ‘দিনে প্রায় দুই ঘণ্টা চলে যায় পানি টানতে। গত বছর বাড়িতে টিউবয়েল বসাইছিলাম। কিন্তু পানি ভালো না, লবণাক্ত। তাই এখন থেকেই খাওয়ার পানি নিতে হয়।’

দূরদূরান্ত থেকে খাওয়ার পানি নিয়ে ফিরছেন এক নারী। গত মঙ্গলবার শরণখোলার খুড়িয়াখালী এলাকায়

এই পুকুর থেকে ১০ বছর ধরে পানি নিয়ে আশপাশে বিক্রি করেন আল আমিন হাওলাদার। ৪০ লিটারের এক একটি ড্রামভর্তি পানি তিনি বিক্রি করেন ২০ টাকা করে। তিন বছর আগেও একই এক ড্রাম পানি তিনি বিক্রি করতেন পাঁচ টাকা। তিনি বলেন, ‘আমাগো এলাকার খাওয়ার পানির খুব কষ্ট। বর্ষা বাদে অন্য সময়ে আমি এই পুকুর থেকে পানি নিয়ে বাসা-বাড়ি ও দোকানে দেই। এই পানি অনেকে ফিটকিরি দিয়ে ও ফুটোয়ে খায়। আমার অধীনে আরও পাঁচজন আছে এখান থেকে পানি নিয়ে দেয়। আমারই দৈনিক ৩০০ ড্রাম পানির চাহিদা আছে। এখন পানি দিয়ে পারছি না।’

পানির কষ্টের কথা বলতে গিয়ে চোখ ভিজে আসছিল শরণখোলার সাউথখালী ইউনিয়নের খুড়িয়াখালী গ্রামের দিনমজুর মোফাজ্জেল হাওলাদারের। বাড়ির পুকুর শুকিয়ে যাওয়াতে খাওয়ার পানির মতো গোসল, থালা-বাসন ধোয়া এমনকি টয়লেটে ব্যবহারের পানিও তাকে সংগ্রহ করে আনতে হয় দূর থেকে। তাঁর পরিবারের খাওয়ার পানি সংগ্রহ করতে হয় প্রায় দুই কিলোমিটার দূরের চালিতাবুনিয়া গ্রামের একটি পুকুর থেকে। এই দীর্ঘ পথে তাঁকে পাড়ি দিতে হয় বাঁশের সাঁকোও। ১৪ এপ্রিল পানি আনতে গিয়ে পড়ে গিয়ে মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙেছে মোফাজ্জেলের স্ত্রী তাজিনুর বেগমের। এখন তাঁর চিকিৎসা চলছে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

গ্রামে পানি সংগ্রহের কাজটা সাধারণত পরিবারের নারী সদস্যদেরই। মোফাজ্জেলের পরিবারের জন্য এখন পানি সংগ্রহ করেন তাঁর পুত্রবধূ কামরুননাহার বেগম। খাওয়ার পানির মতো তাঁকে পরিবারের অন্য সব ব্যবহার্য কাজের জন্য পানি আনতে হয় দূর থেকে। কামরুননাহার বলেন, ‘আমাগো পানির যে কী কষ্ট, তা বোঝানো যাবে না। বাড়ি তিনডে গরু। এক মাস হলো পানি বিনে গরুগুলোরে গোছল করাতে পারি না।’

শরণখোলা-মোরেলগঞ্জ অঞ্চলে বিশুদ্ধ পানির চাহিদা মেটাতে ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বসেছে প্রচুর পন্ড স্যান্ড ফিল্টার বা পিএসএফ। সরকারিভাবে কেবল শরণখোলা উপজেলার চারটি ইউনিয়নে সে সময় তৈরি করা হয় ৫৪৭টি পিএসএফ। এর বাইরে বিভিন্ন এনজিও এবং দাতা সংস্থার পক্ষ থেকেও নির্মাণ করা হয় কয়েক শ পিএসএফ। যার বড় একটি অংশ অকার্যকর হয়ে পড়ে আছে। যেগুলো সচল ছিল, পুকুর শুকিয়ে তারও বেশির ভাগই এখন অকেজো।

স্বাস্থ্য বিভাগ ও উপজেলা প্রশাসনের অনুরোধে দুটি ভ্রাম্যমাণ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের মাধ্যমে শরণখোলায় বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ শুরু করেছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। গত মঙ্গলবার একটি প্ল্যান্টের মাধ্যমে পানি দেওয়া হয় বকুলতলা এলাকায়। সেখানে সকাল থেকে শত শত মানুষ লাইন দিয়েছে এক কলসি খাওয়ার পানি সংগ্রহের জন্য।

ওই লাইনে দাঁড়ানো বকুলতলা গ্রামের লাইলি বেগম বলেন, ‘সকাল ৯টায় এসে লাইনে দাঁড়াইছি। জোহরের নামাজটাও পড়তে পারিনি। বেলা দুইটা বেজে গেছে এখনো এক কলস পানি পাইনি।’

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের বাগেরহাট কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলীর এফ এম ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘বর্তমানে ছয়টি ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট শরণখোলা, মোংলা ও মোরেলগঞ্জ উপজেলায় ঘুরে ঘুরে দিনভর পানি সরবরাহ করছে। এই প্ল্যান্টগুলো ঘণ্টায় ৬০০ লিটার পানি ফিল্টার করতে পারছে।’