উন্নত জীবনের স্বপ্ন নিয়ে চার মাস আগে বাড়ি ছেড়েছিলেন যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার খাটবাড়িয়া গ্রামের তরুণ রাকিবুল ইসলাম (২০)। দালালের মাধ্যমে তিনি পাড়ি দেন লিবিয়ায়। কিন্তু দালাল চক্র লিবিয়ার একটি শহরে তাঁকে আটকে রেখে নির্যাতন শুরু করে। পরিবারের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে মুঠোফোনে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। পরিবারের লোকজন টাকা দিতে রাজিও হন। এরই মধ্যে খবর এল দালাল চক্র রাকিবুলকে গুলি করে হত্যা করেছে।
গৃহযুদ্ধকবলিত দেশ লিবিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় মিজদা শহরে বৃহস্পতিবার ২৬ বাংলাদেশিসহ ৩০ অভিবাসীকে খুন করা হয়। তাঁদেরই একজন এই রাকিবুল। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার ছয় বাসিন্দা রয়েছেন বলে পুলিশ জানিয়েছে।
রাকিবুলের বড় ভাই সোহেল রানা প্রথম আলোকে বলেন, উন্নত জীবনের আশায় দেশ ছেড়েছিলেন রাবিকুল। ভালো কাজের জন্য দালালের মাধ্যমে তাঁকে লিবিয়ায় পাঠানো হয়। কিন্তু শুরু থেকেই দালালেরা তাঁর সঙ্গে খারাপ আচরণ করতে থাকে। পরে তাঁকে আটকে রেখে ১৭ মে মুঠোফোনে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। ওই টাকা দুবাই থেকে তারা নিতে চায়। ভাইয়ের মুক্তির জন্য ওই টাকা দিতে রাজিও হয়েছিলেন তাঁরা। আগামী ১ জুন পর্যন্ত তাঁদের কাছ থেকে সময় নিয়েছিলেন। কিন্তু এর মধ্যে কী হয়ে গেল কিছুই বুঝতে পারলেন না। তাঁর চাচাতো ভাই সকালে লিবিয়া থেকে ফোন করে জানিয়েছেন, যে ২৬ বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, তার মধ্যে রাকিবুলও রয়েছেন। সোহেল রানা বলেন, ‘আমরা এখন কী করব কিছুই বুঝতে পারছি না। লাশ কবে দেশে আসবে, তা–ও জানি না।’
পরিবার সূত্রে জানা গেছে, রাকিবুল যশোর সরকারি সিটি কলেজে অর্থনীতি বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন। রাকিবুলের চাচাতো ভাই লিবিয়াপ্রবাসী। ওই ভাই লিবিয়ায় থাকা এক বাংলাদেশি দালালের সঙ্গে যোগাযোগ করে রাকিবুলকে লিবিয়ায় নিয়ে যান। চার মাস আগে সাড়ে চার লাখ টাকা খরচ করে রাকিবুলকে লিবিয়ায় পাঠান পরিবারের লোকজন। চার ভাইবোনের মধ্যে রাকিবুল সবার ছোট। যে কারণে তাঁর মৃত্যুর খবরে মা-বাবা, ভাই-বোন মুষড়ে পড়েছেন। তাঁদের বাড়িতে এখন শোকের মাতম চলছে।
এদিকে কিশোরগঞ্জের ভৈরব থানার পরিদর্শক (তদন্ত) বাহালুল আলম খান জানান, লিবিয়ায় নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ভৈরবের ছয়জন বাসিন্দা রয়েছেন বলে তাঁরা জানতে পেরেছেন। নিহতদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে তাঁরা এই তথ্য নিশ্চিত হয়েছেন। আহতও বেশ কয়েকজন আছেন।
উপজেলার সাদেকপুর ইউনিয়নের রসুলপুর গ্রামের বাসিন্দা মোবারক হোসেন প্রথম আলোকে জানান, তাঁর ছোট ভাই সাদ্দাম হোসেন (২৫) হতাহতের মধ্যে রয়েছেন। প্রথমে তাঁরা মৃত্যুর খবর পেলেও পরে জানতে পারেন সাদ্দাম বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
পরিবার সূত্র জানায়, ছয় ভাই ও তিন বোনের মধ্যে সাদ্দাম সবার ছোট। এক বছর আগে স্থানীয় এক দালালের মাধ্যমে ভালোভাবেই লিবিয়া যান। খরচ হয় তিন লাখ ৬০ হাজার টাকা। কিন্তু সেখানে গিয়ে সুবিধা করতে পারেননি। শেষে লিবিয়ায় অবস্থান করা ভৈরবের এক দালালের মাধ্যমে ইতালিতে পাড়ি জমানোর ফাঁদে পা দেন।
সাদ্দামের বড় ভাই মোবারক হোসেন বলেন, ‘দুর্ঘটনার কিছু সময় আগে ভয়েস কল আসে। সেখানে কান্না আর জীবন শঙ্কার কথা ছাড়া আর কিছু ছিল না। যেভাবেই হোক টাকা দিয়ে বাঁচানোর কথা বলছিল আমার ভাই। কিন্তু টাকা জোগাড় করার আগেই মারা পড়ে আমার ভাই।’
মোবারক জানান, ঘটনার কিছুদিন আগে থেকেই সাদ্দামের সঙ্গে ফোনে কথা হচ্ছিল। তাঁর মাধ্যমে জানতে পেরেছেন জালাল তানজিরুল নামের একজন মানব পাচারকারী রয়েছেন। বাবার নাম সোনা মিয়া। বাবা বেঁচে নেই। বাড়ি ভৈরবের শ্রীনগর ইউনিয়নের শ্রীনগর গ্রামে। মূলত তাঁর মাধ্যমে ইতালি যাওয়ার পরিকল্পনা করা হয়। টাকা চাওয়া হয় ২ লাখ ৬০ হাজার। ৬০ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়। কথা ছিল ইতালি পৌঁছার পর বাকি টাকা পরিশোধ করার।
মোবারকের অভিযোগ, জালাল তানজিরুল লিবিয়ার বেনগাজি থেকে ত্রিপোলি নিয়ে যাওয়ার পথে সবাইকে অন্য একটি চক্রের কাছে বিক্রি করে দেন। চক্রটি সবাইকে নির্জন স্থানে নেওয়ার পর মুক্তিপণ চেয়ে শারীরিক নির্যাতন শুরু করে। মুক্তিপণ হিসেবে চাওয়া হয় ১০ লাখ টাকা।
একই অভিযোগ করেন নির্মমতার শিকার ভৈরবের শিবপুর ইউনিয়নের শম্ভুপুর গ্রামের জানু মিয়ার (২৪) বড় ভাই জহির মিয়া। পুলিশ প্রথমে জানু মিয়ার মারা যাওয়ার খবর দিলেও পরিবারের সদস্যরা বলছেন, জানু মারা যাননি। হাসপাতালে অচেতন অবস্থায় রয়েছেন।
জহির মিয়া বলেন, ‘দুর্ঘটনার কিছুক্ষণ আগে আমার ভাইও আমার কাছে ভয়েস রেকর্ড পাঠান। সেখানে শুধু নির্যাতন চালানোর কথা বলা হয়েছে। আর কিছুক্ষণ পর মেরে ফেলতে পারে—এমন শঙ্কার কথাও ছিল।’