হাজারো ব্যস্ততা? কাজের চাপ? হঠাৎ মিলল একটুখানি অবসর। ভাবছেন কোথায় যাবেন? ভাবতে ভাবতে সময় শেষ করতে হবে না। প্রিয়জন কিংবা বন্ধুবান্ধবসহ ঘুরে আসতে পারেন সিংড়া ফরেস্টে। বনের ভেতরে এলোমেলো পথে খুঁজে পাবেন অপরূপ সুন্দর নিরিবিলি পরিবেশ। শাল-সেগুনসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছগাছালির সমন্বয়ে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা সিংড়া বন। শ্রাবণের বৃষ্টিতে স্নান সেরে শরতের আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে গাছপালা। সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ছে তাদের গায়ে। সুনসান নীরবতা। যেন এক টুকরা সুন্দরবন।
বলছি দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার ভোগনগর ইউনিয়নে অবস্থিত সিংড়া ফরেস্টের কথা। স্থানীয়ভাবে এই বন সিংড়া শালবন নামে পরিচিত। জেলা শহর থেকে মাত্র ৪০ কিলোমিটার দূরে। ঢাকা-পঞ্চগড় মহাসড়ক থেকে নেমে মাত্র দুই কিলোমিটার উত্তরে পিচঢালা পথ আপনাকে নিয়ে যাবে সিংড়া বনের ভেতরে। বনে ঢোকার মুখেই পাবেন সরকারি রেস্টহাউস। কিছুক্ষণ বিশ্রাম। তারপর ঘুরে ঘুরে দেখা।
দিনাজপুর সামাজিক বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী ৮৫৯ দশমিক ৯৩ একর জমির ওপরে অবস্থান কর
ছে এই সিংড়া শালবন। ১৮৮৫ সালে এই বনকে অধিভুক্ত করা হয়। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৪ সালে বন বিভাগের অধীনে নিয়ে গেজেট প্রকাশ করা হয়। তারও পরে প্রাকৃতিক পরিবেশ উন্নয়ন, বন্য প্রাণী সংরক্ষণ এবং পর্যটন সুবিধার উন্নয়নের জন্য ২০১০ সালের অক্টোবর মাসে বন বিভাগ এটিকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করে।
এই বনে মূলত পাতাঝরা শালবৃক্ষের আধিক্য দেখা যায়। কিন্তু শাল ছাড়াও এখানে রয়েছে জারুল, তরুল, শিলকড়ই, শিমুল, মিনজিরি, সেগুন, গামারি, আকাশমণি, ঘোড়ানিম, সোনালু, গুটিজাম, হরীতকী, বয়রা, আমলকী, বেতসহ বিভিন্ন রকমের উদ্ভিদ ও লতাগুল্ম। টগর, জুঁই, বনবেলি, হৈমন্তী ফুলেরও দেখা মিলবে সিংড়া শালবনে। ভেষজ উদ্ভিদের মধ্যে রয়েছে শতমূল, অনন্তমূল, গুলঞ্চ, যষ্টিমধু, আকন্দ, মাছ আলু। তবে ইতিমধ্যে দর্শনার্থীদের কৌতূহল বাড়িয়েছে গিলা লতা নামক লম্বা এক উদ্ভিদ। পুরো বনের মধ্যে এই গিলা লতা দেখে টারজানের কথা মনে পড়েনি এমন মানুষের সংখ্যা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। পাটের দড়ির মতো ঝুলে থাকে গিলা লতা। সম্প্রতি এই গাছে ঝুলতে দেখা যায় হাইব্রিড শিমের মতো লম্বা লম্বা ফল। বন বিভাগ ইতিমধ্যে গাছটির চারপাশে প্রায় এক কাঠা জমিজুড়ে বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরে রেখেছে। গহিন বনের পথ মাড়িয়ে তবু দর্শক একবার দেখার জন্য প্রতিনিয়তই ভিড় করছে গিলা লতার গোড়ায়।
উইয়ের ঢিবির কথা কে না জানে। কিন্তু দেখেছে কজন। সিংড়া শালবনের মধ্যে দেখা মিলবে হাজার হাজার উইয়ের ঢিবি। একেকটির উচ্চতা ছয় থেকে সাত ফুট পর্যন্ত। দূর থেকে দেখে মনে হবে ঝড়ে ভেঙে পড়া কোনো গাছের গোড়া। কাছে গেলেই রহস্য উন্মোচিত হবে, দেখা যাবে এটি নিখুঁতভাবে বানানো উইয়ের বাসা।
বনে ঢুকলেই শোনা যাবে পাখির কিচিরমিচির শব্দ। যেন পাখিদের হাট বসেছে। আছে তিলা ঘুঘু, রাজঘুঘু, কাঠঠোকরা, বুলবুলি, হাঁড়িচাচা পাখি। রয়েছে প্রকৃতির ঝাড়ুদার হিসেবে খ্যাত শকুন পাখি। শীতপ্রধান এলাকা থেকে আসা এসব শকুনের জন্য বন বিভাগ বাঁশ দিয়ে একটি ঘর নির্মাণ করেছে। বিপদগ্রস্ত শকুনদের সেখানে পুনর্বাসনের মাধ্যমে সেবা দেওয়া হচ্ছে। শীত শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শকুনগুলোকে আবার অবমুক্ত করা হয়। পাখি ছাড়াও এখানে দেখা মেলে খরগোশ, শিয়াল, সাপ, বেজিসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর। তবে স্থানীয় মোহন্ত চন্দ্র রায় (৬৫) জানান, বাপ-দাদার মুখে তাঁরা এই বনে নীলগাই, বাঘ, হরিণ থাকার কথা শুনেছেন। এখন আর সেগুলো এই বনে নেই।
সিংড়া বনের সৌন্দর্য শতগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে বনের ভেতর দিয়ে বয়ে চলা নর্ত নদ। ঠাকুরগাঁও জেলার টাঙ্গন নদ থেকে উৎপত্তি লাভ করে সিংড়া বনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বীরগঞ্জের ঢেপা নদীতে গিয়ে মিশেছে নর্ত নদ। শুকনা মৌসুমে তেমন পানি না থাকলেও ভরা বর্ষায় নদটি যেন খুঁজে পায় তার নতুন যৌবন। বনের অন্য প্রান্তে যেতে সেই নর্ত নদের ওপরে চোখে পড়বে ছোট একখানা সেতু। সেতুর ওপরে দাঁড়ালে নদের স্বচ্ছ পানি দেখে মুগ্ধ হয়ে যেতে হবে।
বনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত মূল রাস্তার প্রায় শেষ প্রান্তে দেখা মিলবে ছোট ছোট মাটির ঘর। জগতের সব ভয়ভীতি উপেক্ষা করে ৬০-৭০টি আদিবাসী পরিবার বসবাস করছে এখানে। বেশির ভাগই সাঁওতাল। বনের গাছপালা, লতাগুল্ম আর শিয়াল, বেজির সঙ্গে যেন তাদের গভীর মিতালি। এখনো সিংড়া বন থেকে বেশ কিছু খাদ্য উপাদান তারা সংগ্রহ করে। বন বিভাগ ইতিমধ্যে বন্য প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কমিটি গঠন করেছে সেখানে। সেই কমিটিতে আদিবাসীদের নিয়ে নয়টি বন রক্ষা কমিটি গঠন করা হয়েছে।
প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা এই শালবন ইতিমধ্যে একটি বনভোজন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। সিংড়া শালবনের বিট কর্মকর্তা হরিপদ দেবনাথ জানান, শীত ও বর্ষা—দুই মৌসুমেই দর্শনার্থীরা আসে এখানে। বিশ্রামের জন্য রয়েছে রেস্টহাউস, বনভোজনের রান্নাবান্না করার জন্য রয়েছে আলাদা শেড। আর রয়েছে ছোটদের খেলার সরঞ্জাম।
সারি সারি আকাশছোঁয়া দীর্ঘকায় শাল, সেগুন আর লতাগুল্ম, শান্ত শীতল সবুজাভ প্রকৃতি যখন আপনাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে, তখন আর দেরি কেন? ঢাকা থেকে বিমানযোগে সরাসরি সৈয়দপুর। সেখান থেকে বাস কিংবা মাইক্রোবাসযোগে সোজা সিংড়া ফরেস্ট। এ ছাড়া ঢাকা থেকে রয়েছে এসি/নন-এসি বাস সার্ভিস। সরাসরি বীরগঞ্জ শহরে বাস থেকে নেমে বনে যাওয়া যাবে। এ ছাড়া ট্রেনেও যেতে পারেন। সে ক্ষেত্রে সৈয়দপুর অথবা দিনাজপুরে নেমে তারপর বাসে বা ভাড়ার গাড়িতে সিংড়া ফরেস্টে যেতে পারেন।