কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। আজ মঙ্গলবার বিকেলে বালুখালী ক্যাম্প-৫-এ লাগা আগুনে প্রায় ৩০০ রোহিঙ্গা বসতি পুড়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আরও অন্তত ১০০ বসতবাড়ি। আগুনে পুড়ে তিন বছর বয়সী এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া আহত হয়েছে অন্তত ২০ রোহিঙ্গা নারী ও শিশু। এ ঘটনায় অন্তত দুই হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী গৃহহীন হয়ে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে।
প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন রোহিঙ্গা বলেন, বিকেল পৌনে চারটার দিকে বালুখালী ক্যাম্প-৫-এর বি-ব্লকের মোছরাবাজার এলাকার পাহাড়ের ঢালুর একটি রোহিঙ্গা পরিবারের রান্নাঘর থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। মুহূর্তে আগুন চারপাশের রোহিঙ্গা বসতিতে ছড়িয়ে পড়ে। সাড়ে পাঁচটার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও অন্তত ১০ শিশু নিখোঁজ হয়। অগ্নিকাণ্ডের সময় প্রাণ বাঁচাতে শরণার্থীরা ঘর ছেড়ে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করতে থাকে, তখন শিশুরা পথ হারিয়ে নিখোঁজ হয়। সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া শিশুর পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি।
ঘটনাস্থল থেকে উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নিজাম উদ্দিন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, অগ্নিকাণ্ডে চার শতাধিক রোহিঙ্গা পরিবারের ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৩০০ ঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এখন খোলা আকাশের নিচে দুই হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী। তাদের অস্থায়ী আশ্রয়শিবিরে সরানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
ইউএনও বলেন, আগুন লাগার বিষয়ে নানা কথা কানে আসছে। কেউ বলছেন, এক রোহিঙ্গা পরিবারের রান্নাঘরের গ্যাসের চুল্লি থেকে আগুনের সূত্রপাত। আবার কেউ বলছেন, দোকান থেকে আগুন ছড়িয়েছে। পুরো বিষয়ে অনুসন্ধান না করে এই মুহূর্তে আগুনের সূত্রপাত নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানান তিনি।
স্থানীয় রোহিঙ্গা নেতা সৈয়দ করিম (৪৯) প্রথম আলোকে বলেন, গত বছরের ২২ মার্চ পাশের বালুখালী (ক্যাম্প-৮, ৯ ও ১০) শিবিরে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গার ঘর পুড়ে ছাই হয়েছিল। তখন মারা গিয়েছিল ৬ শিশুসহ ১৫ রোহিঙ্গা শরণার্থী। এবার আগুন দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব না হলে আরও কয়েক হাজার মানুষের ঘর পুড়ে ছাই হয়ে যেত।
পুলিশ ও স্থানীয় রোহিঙ্গারা বলে, বালুখালী ক্যাম্প-৫-এর বি-ব্লকের মোছরাবাজার এলাকার পাশে পাহাড়ের ঢালুতে তৈরি কয়েক হাজার রোহিঙ্গার আশ্রয়শিবির। আগুনে পুড়ে যাওয়া অধিকাংশ ঘর পাহাড়ের ঢালুতে। এখানকার একটি বসতি থেকেই আগুনের সূত্রপাত হয়েছে।
স্থানীয় রোহিঙ্গা শরণার্থী আবুল ফজল (৫৫) বলে, পৌনে চারটার দিকে সে বাড়ির পাশের পাহাড়ে দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ দক্ষিণ দিকে একটি ঘরে আগুন জ্বলতে দেখে সে। তখন উত্তর-দক্ষিণ কোনার দিক থেকে তীব্রগতির বাতাস ছুটে আসছিল। মুহূর্তে সেই আগুন তার ঘরের কাছাকাছি চলে আসে। একসময় প্রাণ বাঁচাতে সে ঘরের লোকজন নিয়ে পাশের পাহাড়ে আশ্রয় নেয়।
আবুল কালাম (৫৫) নামের আরেক রোহিঙ্গা বলে, গ্যাস সিলিন্ডার থেকে আগুনের সূত্রপাত। অধিকাংশ রোহিঙ্গা গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করতে জানেন না। তা ছাড়া রোহিঙ্গা বসতিগুলো বাঁশের খুঁটিতে ত্রিপল দিয়ে তৈরি। একটার সঙ্গে আরেকটা লাগানো। একটা ঘরে আগুন ধরলে অন্য ঘরগুলো রক্ষার উপায় নেই।
রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক ও পুলিশ সুপার নাঈমুল হক বলেন, রোহিঙ্গা শিবিরে আগুন লাগার খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে এপিবিএনের সদস্যরা ছুটে যান। এরপর তাঁরা আগুন নেভানোর কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। পাশাপাশি ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরাও ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেন। বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসে। আগুনে এক রোহিঙ্গা শিশুর মৃত্যু হলেও তার পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি।
উখিয়া ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের স্টেশন কর্মকর্তা মো. এমদাদুল হক বলেন, ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে তিন শতাধিক রোহিঙ্গার ঘর সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। কিছু ঘর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে আগুনের সূত্রপাত সম্পর্কে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
রোহিঙ্গা স্বেচ্ছাসেবী আমির হোসেন ও নুর মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, চোখের সামনে এক ঘণ্টার আগুনে তিন শতাধিক রোহিঙ্গা বসতি পুড়ে ছাই হয়ে গেল। দুই হাজার রোহিঙ্গা এখন খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। ক্যাম্পে বারবার আগুন লাগার ঘটনা ঘটলেও এর স্থায়ী সমাধান মিলছে না।
গত ২৫ ফেব্রুয়ারি দুপুরে উখিয়ার কুতুপালং (ক্যাম্প-৭) আশ্রয়শিবিরের এ-ব্লকে (টিভি টাওয়ার ও ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল–সংলগ্ন কাঁটাতারের বাইরে) অগ্নিকাণ্ডে ১০টি দোকান পুড়ে যায়। তার আগে ৯ জানুয়ারি উখিয়ার শফিউল্লাহকাটা আশ্রয়শিবিরে অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ৬০০ রোহিঙ্গা বসতি ভস্মীভূত হয়। এতে তিন হাজার রোহিঙ্গা গৃহহীন হয়ে পড়েছিল। ২ জানুয়ারি বালুখালী (ক্যাম্প-২০) আশ্রয়শিবিরে জাতিসংঘের অভিবাসনবিষয়ক সংস্থা (আইওএম) পরিচালিত করোনা হাসপাতালের আইসোলেশন সেন্টার পুড়ে যায়। সবচেয়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে গত বছরের ২২ মার্চ বিকেলে বালুখালী আশ্রয়শিবিরে। সেই অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে ছাই হয় ১০ হাজার ২০০টি ঘর। ওই সময় ৬ শিশুসহ অন্তত ১৫ রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়। এতে গৃহহীন হয় অন্তত ৪০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী।