বিয়ের ১০ মাসের মাথায় নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনায় স্বামী জাহাঙ্গীর আলমকে হারান শামসুন নাহার ওরফে নূপুর। স্বামী হারানোর দুই মাস পর নূপুরের কোলজুড়ে পৃথিবীতে আসে একমাত্র মেয়ে রওজা। প্রতিবছর ঈদ এলেও আনন্দ নেই নূপুরের পরিবারে। স্বামী ও সন্তানের বাবা ছাড়া তাদের আনন্দের ঈদগুলো কাটে কষ্টে। ঈদ এলেও বিষাদে মন ভরে থাকে নূপুরের।
২০১৪ সালে নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুনের ঘটনায় সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজন নিহত হন। তাঁদের মধ্যে নিহত নজরুলের বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন ও তাঁর গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলমও ছিলেন। নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের কদমতলী এলাকায় জাহাঙ্গীরের বাড়ি। মেয়েসহ শ্বশুরবাড়িতে থাকছেন নূপুর।
স্বামী হারানোর ২ মাস ১০ দিন পর মেয়ে রওজা তাঁর কোলে আসে। কিন্তু মেয়েটি তার বাবার মুখটিও একবারের জন্য দেখতে পারেনি। অন্য শিশুরা নতুন কাপড় পরে তাদের বাবার সঙ্গে ঈদে বেড়াতে যায়। অনেক আনন্দ করে। কিন্তু রওজার বাবা না থাকায় সারাক্ষণ কান্নাকাটি করে। মন খারাপ করে থাকে। ছবির বাবার সঙ্গে তার কত বায়না!নিহত জাহাঙ্গীর আলমের স্ত্রী শামসুন নাহার ওরফে নুপুর
নূপুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘১০ মাসের সংসারে স্বামীর সঙ্গে দুটি ঈদ পেয়েছিলাম। শ্বশুরবাড়িতে আসার পর স্বামীর সঙ্গে একটিও ঈদ করতে পারিনি। সব সময় তাঁর কথা মনে পড়ে।’ আক্ষেপ করে বলেন, ‘স্বামী ছাড়া ঈদের আনন্দ লাগে না। ঈদের দিনগুলোতে তাঁকে বেশি অনুভব করি। স্বামী হারানোর ২ মাস ১০ দিন পর মেয়ে রওজা তাঁর কোলে আসে। কিন্তু মেয়েটি তার বাবার মুখটিও একবারের জন্য দেখতে পারেনি।’
নূপুর আরও বলেন, ‘অন্য শিশুরা নতুন কাপড় পরে তাদের বাবার সঙ্গে ঈদে বেড়াতে যায়। অনেক আনন্দ করে। কিন্তু রওজার বাবা না থাকায় সারাক্ষণ কান্নাকাটি করে। মন খারাপ করে থাকে। ছবির বাবার সঙ্গে তার কত বায়না! রওজাকে তার বড় চাচা নতুন জামা কিনে দিয়েছেন।
জাহাঙ্গীরের মেয়ে রওজা বলে, সবাই ঈদে নতুন জামা পরে আব্বুর সঙ্গে ঘুরতে যায়। তার তো আব্বু নেই। তাই সে ঘুরতে যেতে পারে না। আব্বুর জন্য তার অনেক খারাপ লাগে।
জাহাঙ্গীরের মা মেহেরুন নেছা প্রথম আলোকে বলেন, ছেলের কথা খুব মনে পড়ে। নাতনিটা বাবার জন্য মন খারাপ করে থাকে। বড় চাচাকে (শাহজাহান) আব্বু বলে ডাকে। তিনি বলেন, আট বছর হয়ে গেল, ছেলের হত্যাকারীদের রায় কার্যকর হলো না। তিনি ছেলের হত্যাকারীদের বিচার দেখে যেতে চান। ছেলে হারানোর ব্যথা যে কত কষ্টের, তা বলে বোঝানো যাবে না।
সাত খুনে স্বজনহারা পরিবারগুলো আনন্দে নেই। উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে পরিবারগুলো সংকটে আছে। বিশেষ করে নিহত জাহাঙ্গীর, আইনজীবী চন্দন সরকারের গাড়িচালক ইব্রাহিমের পরিবার ও তাজুল ইসলামের পরিবার খুব কষ্টে আছে।নিহত মনিরুজ্জামান স্বপনের ছোট ভাই কাউন্সিলর রিপন খান
নিহত মনিরুজ্জামান স্বপনের ছোট ভাই কাউন্সিলর রিপন খান বলেন, সাত খুনে স্বজনহারা পরিবারগুলো আনন্দে নেই। উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে পরিবারগুলো সংকটে আছে। তিনি বলেন, নিহত জাহাঙ্গীর, আইনজীবী চন্দন সরকারের গাড়িচালক ইব্রাহিমের পরিবার ও তাজুল ইসলামের পরিবার খুব কষ্টে আছে। সরকারিভাবে তারা কোনো সহযোগিতা পায়নি।
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের সদর উপজেলার লামাপাড়া এলাকা থেকে সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম ও আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজনকে অপহরণ করা হয়। তিন দিন পর ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদী থেকে তাঁদের লাশ উদ্ধার করা হয়।
নিহত ওই সাতজন হলেন প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, তাঁর বন্ধু যুবলীগ কর্মী মনিরুজ্জামান স্বপন ও তাঁর গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম, লিটন, শেখ রাসেল জাতীয় শিশু–কিশোর পরিষদের সিদ্ধিরগঞ্জ থানা কমিটির সহসভাপতি তাজুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকার ও তাঁর গাড়িচালক ইব্রাহিম।
এ ঘটনায় নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম ও নিহত আইনজীবী চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার বাদী হয়ে ফতুল্লা মডেল থানায় পৃথক দুটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। আলোচিত এ মামলায় ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালত সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন, র্যাব-১১-এর চাকরিচ্যুত সাবেক অধিনায়ক লে. কর্নেল তারেক সাঈদ, মেজর আরিফ হোসেন, লে. কমান্ডার এম এম রানাসহ ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেন আদালত। নিম্ন আদালতের রায়ের পর উচ্চ আদালতে ২০১৮ সালের ২২ আগস্ট ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ বহাল রেখে অন্য আসামিদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা বহাল রাখা হয়। বর্তমানে মামলাটি আপিল বিভাগে আসামিপক্ষের আপিল নিষ্পত্তির জন্য শুনানির অপেক্ষায় আছে।