কক্সবাজার ও কুয়াকাটা

ইয়াসের ক্ষত সৈকতের বুকজুড়ে

ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাব, জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাসে বেশি ক্ষতি হয়েছে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতের। ভাঙন দেখা দিয়েছে কক্সবাজারে মেরিন ড্রাইভ সড়কের বিভিন্ন অংশেও।

ইয়াসের প্রভাবে সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের আঘাতে বিধ্বস্ত কুয়াকাটা সৈকত
ছবি: প্রথম আলো

ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাব, জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাসে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতের। বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সৈকতের পাকা স্থাপনা ধসে পড়েছে। উপড়ে গেছে গাছপালা। সৈকত লাগোয়া দুই শতাধিক অস্থায়ী ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের স্থাপনা বিধ্বস্ত হয়েছে।

ভাঙন দেখা দিয়েছে কক্সবাজারে মেরিন ড্রাইভ সড়কের বিভিন্ন অংশেও। সড়কটির হিমছড়ি ঝরনা এলাকায় একটি ভবন সাগরের দিকে হেলে পড়েছে। ভবনের নিচের মাটিও সরে গেছে।

করোনার সংক্রমণরোধে কুয়াকাটায় পর্যটকদের আগমন বন্ধ রয়েছে। এ কারণে আগের প্রাকৃতিক অবস্থায় ফিরে যাচ্ছিল কুয়াকাটা। কিন্তু শান্ত কুয়াকাটা সৈকতকে ক্ষত-বিক্ষত করে দিয়ে গেছে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস। জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাসের আঘাতে সৈকতসংলগ্ন আবাসিক হোটেল কিংস, ঝিনুক মার্কেট, শুঁটকি মার্কেট, স্টুডিও মার্কেট, সরদার মার্কেটসহ সৈকতের দুই শতাধিক অস্থায়ী ক্ষুদ্র ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের স্থাপনা বিধ্বস্ত হয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) পটুয়াখালী কার্যালয় জানায়, জলোচ্ছ্বাসে কুয়াকাটা সৈকতের অন্তত ৫০০ মিটার তীরভূমি ভেঙে গেছে। সৈকতের ভাঙন ঠেকাতে প্রতিরক্ষা কাজ চলমান থাকায় ক্ষতি কম হয়েছে বলে মনে করছে পাউবো।

কক্সবাজার / জোয়ারের ধাক্কা লেগেছে টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপ জালিয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবনেও। শুক্রবার বিকালে. ভাটার সময় তোলা

গত শুক্রবার সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, ওই দিনও জোয়ারের সময় সাগরের পানি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে সৈকতে আছড়ে পড়ছে। সৈকতের পাশে হোটেল কিংসের পাকা স্থাপনা ভেঙে পড়ে আছে। সৈকত লাগোয়া তালগাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ উপড়ে পড়ে আছে।

কথা হয় হোটেল কিংসের পূর্ব পাশের বাসিন্দা ফুলবানুর সঙ্গে। তিনি বলেন, তাঁর স্বামী জেলে। তাঁরা এখানে ছোট্ট অস্থায়ী ঝুপড়ি তুলে বসবাস করছেন। কিন্তু জলোচ্ছ্বাসে তাঁদের ঘরের ওপর আছড়ে পড়ে ঘরের সব মালামাল ভেসে যায়।

সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের আঘাতে বিধ্বস্ত কুয়াকাটা সৈকত

কুয়াকাটা সৈকতের জিরো পয়েন্টের পশ্চিম পাশে স্টুডিও মার্কেট। সারা দিন সৈকতে আলোকচিত্রীরা পর্যটকদের ছবি তুলে এনে এখানে প্রিন্ট করেন। কথা হয় সৈকতের ফটোগ্রাফার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস শেখের সঙ্গে। তিনি বলেন, জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গিয়ে ৫০টি মতো স্টুডিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেকের দোকানপাট ভেঙে সমুদ্রগর্ভে চলে গেছে।

ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব কুয়াকাটার (টোয়াক) সভাপতি রুমান ইমতিয়াজ বলেন, প্রতিবছরই প্রাকৃতিক দুর্যোগ এলে ঢেউয়ের আঘাতে কুয়াকাটা সৈকতের ব্যাপক ক্ষতি হয়। পাউবো কর্তৃপক্ষ সৈকতের সুরক্ষায় জিও টিউব দিয়ে অস্থায়ীভাবে সৈকত রক্ষার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছে। এতে প্রতিবছর সরকারের কোটি কোটি টাকা ব্যয় হলেও তেমন একটা কাজে আসছে না। তিনি বলেন, কুয়াকাটাকে রক্ষা করতে হলে প্রয়োজন যুগোপযোগী স্থায়ী প্রকল্প, যে প্রকল্প সৈকত রক্ষা করবে। তা না হলে কুয়াকাটার অস্তিত্ব সংকটে পড়বে।

কুয়াকাটার পৌর মেয়র মো. আনোয়ার হাওলাদার বলেন, ঘূর্ণিঝড় ও জোয়ারের জলোচ্ছ্বাসে সৈকতের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সৈকতের দুই শতাধিক অস্থায়ী স্থাপনা বিধ্বস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের প্রাথমিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।

অধিক উচ্চতার জোয়ারে লণ্ডভণ্ড কুতুবদিয়ার বেড়িবাঁধ, ঢুকছে জোয়ারের পানি

পাউবো পটুয়াখালীর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. হালিম সালেহী প্রথম আলোকে বলেন, ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও পূর্ণিমার জোয়ারের সময় নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। সাগরেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। সাগরের বিশাল বিশাল ঢেউ সৈকতে আছড়ে পড়ে ৫০০ মিটার সৈকতের তীরভূমি ভেঙে পড়েছে। বর্তমানে সৈকতের সুরক্ষায় জিও টিউব প্রকল্প একটি অস্থায়ী গবেষণামূলক প্রকল্পের কাজ চলায় ক্ষতি কম হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। তবে কুয়াকাটা সৈকত রক্ষায় স্থায়ী প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাসে ৮৪ কিলোমিটার দীর্ঘ কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভ সড়কের বিভিন্ন অংশে ভাঙন দেখা গেছে। সড়কের শামলাপুর, বাহারছড়া, মনখালী, উখিয়ার পাটুয়ারটেক, ইনানী, রামুর হিমছড়ি, বড়ছড়া, দরিয়ানগর ও কলাতলী অংশের কিছু স্থানে ভাঙন দেখা গেছে। হিমছড়ি ঝরনা এলাকায় একটি ভবনের বিভিন্ন অংশ ধসে পড়েছে। ভবনটি হেলে পড়েছে সাগরের দিকে। ভবনের নিচের মাটিও সরে গেছে।

কলাতলী থেকে উত্তর দিকে নাজিরারটেক পর্যন্ত ১১ কিলোমিটার সৈকতের লাবণী, শৈবাল, ডায়াবেটিস হাসপাতাল, সমিতিপাড়া, নাজিরারটেক সৈকতে ভাঙন দেখা গেছে। সৈকতের ঝাউগাছও বিলীন হতে দেখা গেছে। সৈকতের নাজিরারটেক এলাকা দিয়ে পানি ঢুকে কক্সবাজার পৌরসভার ১নং ওয়ার্ডের ১৭টি গ্রাম প্লাবিত হচ্ছে।

একইভাবে জেলার মহেশখালী ও কুতুবদিয়া উপজেলার অন্তত ৭২টি পাকা স্থাপনায় জোয়ারের ধাক্কা লাগছে। এর মধ্যে রয়েছে তিনটি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র, ছয়টি শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, ৬৩টি পাকা বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। জোয়ারের ধাক্কায় লন্ডভন্ড হয়ে গেছে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে ওঠানামার পাকা জেটিটি। জোয়ারের ধাক্কা লাগছে সেন্ট মার্টিনের কয়েকটি হোটেল ভবনেও। সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ইউপির চেয়ারম্যান নুর আহমদ বলেন, জোয়ারের এমন তাণ্ডব গত তিন দশকে দেখেননি তিনি।

ইয়াসের প্রভাবে বঙ্গোপসাগরের কক্সবাজার উপকূল এমনিতেই কয়েক দিন ধরে উত্তাল। তার ওপর যুক্ত হয়েছে ভরা পূর্ণিমার প্রভাব। জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ছয়-সাত ফুট উচ্চতায় বেড়ে উপকূলে আছড়ে পড়ছে। শনিবার সকালের জোয়ারেও মহেশখালী, কুতুবদিয়া ও টেকনাফ উপকূলের অন্তত ৬০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. আমিন আল পারভেজ বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের চেয়ে এবার বেশির ভাগ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন জোয়ারের তাণ্ডবে। জোয়ারের ধাক্কায় কয়েক কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। বিলীন হয়ে গেছে অসংখ্য চিংড়ি ও মাছের খামার। ভেঙে গেছে তিন হাজারের বেশি ঘরবাড়ি। এবার জোয়ারের ধাক্কা লেগেছে পাকা স্থাপনায়ও।