কালো পাঞ্জাবি ও পায়জামা পরে এসেছেন ৭৮ বছর বয়সী কাজী মো. দেলোয়ার হোসেন। সকাল থেকে ইমামবাড়া প্রাঙ্গণে ঘুরছেন, প্রিয় হোসাইনের কথা ভেবে বুক চাপড়ে মাতম করছেন। তিনি বলেন, ‘আমার বাবা-দাদারাও এখানে আসতেন। কখনো তাঁদের মুখে শুনিনি তাজিয়া মিছিল না হওয়ার কথা। এবার করোনার কারণে আমরা কোণঠাসা। আমাদের সবার মন খারাপ।’
দেলোয়ারের সঙ্গে কথা হয় আজ রোববার সকাল ১০টার দিকে পুরান ঢাকার হোসেনি দালান ইমামবাড়া প্রাঙ্গণে। করোনাভাইরাস প্রকোপের কারণে এবার রাস্তায় তাজিয়া মিছিল বের হচ্ছে না। সীমিত আকারে একটি সংক্ষিপ্ত মিছিল ইমামবাড়া প্রাঙ্গণেই ঘুরছে। অথচ প্রতিবছর লাখো মানুষের অংশগ্রহণে এই মিছিল বের হয়। শিয়া মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ এই দিনকে শোকের দিন হিসেবে পালন করেন।
এবার মহররমের তাজিয়া মিছিল বড় আকারে না হওয়ায় অনেকেই আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন। অন্তত ১২ জন প্রথম আলোর কাছে এই কষ্টের কথা জানিয়েছেন। ৫৫ বছর বয়সী সৈয়দ আহলে বায়াত নাওয়াজের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘ছোটবেলার আব্বার সঙ্গে আসতাম। কখনো দেখিনি এমন ছোট আয়োজন। মহররমের তাজিয়া মিছিল ছাড়া ভাবাই যায় না। কারবালার ময়দানে ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ইমাম হোসাইন (রা.) জীবন দিয়ে যে দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন, তারই শোক প্রকাশে এমন আয়োজন হয় প্রতিবছর। এখানে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টধর্মের অনুসারীরাও আসে। করোনার কারণে এবার মানুষও কম এসেছে।’
মহররমের এই আয়োজনের মূল উদ্যোক্তা শিয়ারা, তবে সুন্নিরাও এতে অংশ নেন। এমনকি মহররমের দিন হোসেনি দালান ইমামবাড়ায় আসেন পুরান ঢাকার সনাতন ধর্মাবলম্বী এবং অন্য সম্প্রদায়ের মানুষও। তেমনই একজন বংশালের বাসিন্দা হিরামণি। স্বামী ও দুই মেয়েকে সঙ্গে করে ইমামবাড়ায় এসেছেন। তাঁরা প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে তাজিয়া মিছিল দেখছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুরান ঢাকার মানুষ এই দিনে এখানে আসেন। আমার মা মানত করছিল, সেই টান থেকেই আসা। আমার দাদারাও আসত।’
ভোর থেকে হোসেনি দালান ইমামবাড়ায় আসতে থাকেন ভক্তরা। ইমামবাড়ার উত্তর দিকের প্রধান ফটকে দুটি ও দক্ষিণের গেটে দুটি করোনা প্রতিরোধক জীবাণুনাশক টানেল বসানো হয়েছে। তবে এসব টানেল দিয়ে ঢোকার সময় জীবাণুনাশক স্প্রে বন্ধ ছিল। ইমামবাড়ায় ঢুকলেই প্রথমে পড়ে খোলা মাঠ। সে মাঠেই জড়ো হতে থাকেন তাঁরা।
নিশান ও পাকপাঞ্জা নিয়ে কালো–সবুজ পোশাক পরা কিশোর-তরুণ-যুবকেরা ইমামবাড়ার এদিকে–ওদিকে ঘুরছিলেন।
ঠিক সকাল ১০টায় বের হয় মহররমের শোকের মিছিল, হোসেনি দালান ইমামবাড়া ব্যবস্থাপনা কমিটির আয়োজনে। তবে সে মিছিল প্রাঙ্গণেই ঘুরপাক খায়। মিছিলের শুরুতে যুবকেরা ছিলেন নিশান–পাকপাঞ্জা নিয়ে। তারপর ছিল দুটি দুলদুল ঘোড়া। এরপর ছিল হাসান ও হোসেইনের তাজিয়া। সবশেষে ছিলেন কালো পোশাক পরা তরুণেরা। তাঁরা সংক্ষিপ্ত মিছিলের সঙ্গে ‘হায় হোসেন! হায় হোসেন!’ বলে আশুরার মাতম করছিলেন।
ইমামবাড়া কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, প্রতিবছরের মতো এবারও প্রচুর জনসমাগম হয়েছে। তবে ইমামবাড়া চত্বর ছোট হওয়ায় অনেকেই ভেতরে ঢুকতে পারেনি।
ইমামবাড়ার তত্ত্বাবধায়ক এম এম ফিরোজ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘৪০০ বছর ধরে এখান থেকে ঐতিহ্যবাহী তাজিয়া মিছিল বের করা হয়। এ বছর করোনার কারণে তা সীমিত আকারে করা হচ্ছে। সীমিত আকারে করতে গিয়ে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু করোনা প্রাদুর্ভাব যাতে আর বিস্তার না হয়, এটা মেনে নিয়েছি। আমরা যেন আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারি, এটাই প্রার্থনা করছি। আজকের দিনে এটাই চাওয়া।’ তিনি আরও বলেন, ‘ইমামবাড়া প্রাঙ্গণও মানুষে ঠাসা ছিল। বাইরে মিছিল করতে দেওয়া হলে এই সমস্যাটা হতো না। ইমামবাড়া প্রাঙ্গণে স্বাস্থ্যবিধি মানানোর জন্য আমরা চেষ্টা করেছি।’