ষষ্ঠ ধাপে ইউপি নির্বাচন

ইভিএমে ধীরগতি, ভোট পড়েছে ৫৫%

১৩৫টি ইউপির বেসরকারি ফলাফলে বিজয়ী আ.লীগের ৭৬ জন, বিদ্রোহী ২৬, স্বতন্ত্র (বিএনপি) ২১ ও অন্যান্য ১২ জন।

কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ার সুখিয়া ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে কুশাকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোটারের দীর্ঘ সারি।
ছবি: প্রথম আলো

ছোটখাটো, বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ছাড়া গতকাল সোমবার মোটামুটি সুষ্ঠুভাবে ষষ্ঠ ধাপের ইউপি নির্বাচনে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট দেওয়া নিয়ে বিভিন্ন স্থানে জটিলতা দেখা দিয়েছে। আঙুলের ছাপ না মেলায় এবং ইভিএম পদ্ধতি না বোঝায় বয়স্করা ভোট দিতে বেশি বিড়ম্বনায় পড়েছেন। অনেক স্থানে ইভিএমে ত্রুটি দেখা দেয়। ভোটারদের সারি দীর্ঘ হয়। সব মিলিয়ে ইভিএমে ভোট গ্রহণে ধীরগতি ছিল। ভোটও কম পড়েছে। অনেককে দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে ভোট দিতে না পেরে ফিরে যেতে দেখা গেছে।

নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ২১৮টি ইউনিয়ন পরিষদে (ইউপি) নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও গত রোববার দুটি ইউপিতে ভোট গ্রহণ স্থগিত হয়। গতকাল ২১৬টি ইউপিতে ইভিএমে ভোট হয়েছে।

ভোট গ্রহণ শেষে গতকাল বিকেলে রাজধানীতে নির্বাচন ভবনে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়ের সচিব হুমায়ুন কবীর খোন্দকার সাংবাদিকদের বলেন, ভোট গ্রহণ সুষ্ঠু এবং সুন্দর পরিবেশে সম্পন্ন হয়েছে। কোনো কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ স্থগিত করা হয়নি। তবে ইভিএম ভোট গ্রহণে ধীরগতি ছিল। এতে ভোট কম পড়েছে। ৫৫ শতাংশের মতো ভোট পড়েছে।

ইভিএমে ভোট কম পড়ার কারণ জানতে চাইলে ইসি সচিব বলেন, ইভিএমে ভোটের আগে প্রদর্শনী (মক ভোটিং) আয়োজন করা হয়। তাতে প্রত্যাশিতভাবে ভোটাররা আসেন না। এ কারণে ভোট দিতে এলে ইভিএম বোঝাতে সময় লাগে। ফলে বাইরে দীর্ঘ লাইন হয়। এই কারণে অনেকে হয়তো ভোট না দিয়েই ফেরত চলে যান।

ভোট গ্রহণ শেষে গতকাল রাত ১০টা পর্যন্ত ১৩৫টি ইউপির বেসরকারি ফলাফল পাওয়া গেছে। এর মধ্যে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ ৭৬টি ইউপিতে জয়লাভ করেছে। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা জিতেছেন ২৬টিতে, বিএনপি নেতারা স্বতন্ত্র হিসেবে ২১টিতে এবং অন্যান্য দল ও স্বতন্ত্র থেকে ১২টিতে বিজয়ী হয়েছেন।

বয়স্কদের আঙুলের ছাপ মেলে না

গতকাল বেলা দুইটার দিকে নওগাঁর নিয়ামতপুর সদর ইউনিয়নের রূপনারায়ণপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, আটটি বুথের সামনেই ভোটারদের দীর্ঘ সারি। ভোট গ্রহণ চলছে অত্যন্ত ধীরগতিতে। ভোট পড়ার হারও কম। ভোট দিতে আসা বিজলী আদিবাসীপাড়া গ্রামের ভোটার সুবলা রানী (৫৮) জানান, দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর দুপুর ১২টায় তিনি ভোটকক্ষে ঢুকতে পারলেও ভোট দিতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘অনেকবার চেষ্টা করনু, তা-ও আঙুলের ছাপ মিলল না। ভোট লেওয়া লোকেরা বলল হামার আঙুল নাকি ক্ষয়ে গ্যাছে। ছয়-সাতবার মেশিনত আঙুল নাগানু, কিন্তু হামার নাম ও ছবি অ্যালু না।’ একই সমস্যা আরও কয়েকজনের দেখা গেল।

পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জেও আঙুলের ছাপ না মেলায় বিড়ম্বনায় পড়েন ভোটাররা। অনেক নারী ভোটারকে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত লাইনে অপেক্ষা করতে দেখা যায়। দেবীডুবা ইউনিয়নের সুলতানপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে নারী ভোটারদের দীর্ঘ লাইন দেখা গেল বেলা সাড়ে তিনটার দিকে। এই লাইনের পাশেই মাটিতে বসে ভোট দেওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন শরতা রানী (৬৭)। সকালে ভোট দিতে এসে আঙুলের ছাপ না মেলায় একবার ফিরে গিয়েছিলেন। এবার এসেছেন জাতীয় পরিচয়পত্র হাতে নিয়ে। শরতা রানীর মতো একই সমস্যা নিয়ে দীর্ঘ লাইনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে ভোট দেওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন টোলটলীশ্বরী রানী (৬৫)। সুলতানপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা লতিবুল ইসলাম বলেন, ভোটারদের ইভিএম বুঝতে কিছুটা দেরি হচ্ছে।

সিলেট জেলার ১৭‌টি ইউপিতে ভোট গ্রহণে ধীরগ‌তি ছিল। ভোট দিতে গিয়ে আঙুলের ছাপ না মেলায় অনেক ভোটার বিড়ম্বনায় পড়েছেন। ওসমানীনগর উপজেলার তাজপুর ইউনিয়নের তাজপুর সরকা‌রি প্রাথ‌মিক বিদ‌্যালয় কেন্দ্রে সকাল নয়টা থেকে ভোটারদের দীর্ঘ সা‌রি দেখা গেছে। ভোটাররা বলেছেন, ভোট গ্রহণে সময় বেশি লাগছে। বেলা ১১টার দিকে কেন্দ্রটিতে ভোট দিতে আসা উদর কোনা গ্রামের ষাটোর্ধ্ব আবদুল খা‌লিক বলেন, কয়েকবার মে‌শিনে আঙুল দিলেও সে‌টি মেলে‌নি। এ সময় কর্মকর্তা হাত ধুয়ে মে‌শিনে আঙুল দিতে বলেন; এরপরও মেলে‌নি। পরে বেলা দুইটার পর জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে আসতে বলেন।

মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলায় ভোট গ্রহণের শুরুতে কেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি কম দেখা গেলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন কেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি বাড়তে থাকে। বেশির ভাগ কেন্দ্রের সামনে ভোটারদের উপচে পড়া ভিড় চোখে পড়ে। সকাল নয়টার দিকে উলাইল ইউনিয়নের দশচিড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি কিছুটা কম ছিল। তবে আধঘণ্টা পর ভোটারদের ভিড় দেখা যায়। এই কেন্দ্রের ভোটার মতিউর রহমান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ইভিএমে ভোট দিতে অনেক সময় লাগছে। পৌনে এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে ভোট দিতে পেরেছেন। কারও কারও আঙুলের ছাপ না মেলায় ভোট না দিয়ে চলে গেছেন।

ইভিএমে ত্রুটি, ভোট গ্রহণে বিলম্ব

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা ও নবীনগর উপজেলার ১৪টি ইউপির ১৩৩টি ভোটকেন্দ্রে সকাল আটটায় একযোগে ভোট গ্রহণ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে ইভিএমে ত্রুটির কারণে বিলম্বে ভোট শুরু হয়। কসবা উপজেলার সাতটি ইউপিতে ভোটারদের ব্যাপক উপস্থিতি থাকলেও নবীনগরে ভোটার কম ছিল।

নবীনগরের শিবপুর ইউনিয়নের বাঘাউরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের ৯ নম্বর কক্ষে সকাল সাড়ে আটটার দিকে ইভিএমে ত্রুটি দেখা দেয়। বেলা আড়াইটায় একই ইউনিয়নের শিবপুর ইউনিয়ন উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রের ৮ নম্বর কক্ষে ইভিএমে ত্রুটি দেখা দেয়। বেলা আড়াইটার দিকে কসবার মেহারি ইউনিয়নের শিমরাইল উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রের ইভিএমে ত্রুটি দেখা দেয়। এসব কক্ষে এক ঘণ্টার মতো ভোট গ্রহণ বন্ধ থাকে।

প্রিসাইডিং কর্মকর্তা রাশেদুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা গতকাল সবকিছু পরীক্ষা করে নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু সকাল থেকে হঠাৎ কারিগরি ত্রুটি দেখা দেয়। নির্বাচন কমিশনের টেকনিক্যাল টিম কাজ করেছে। ইভিএম ত্রুটির কারণে যথাসময়ে ভোট গ্রহণ শুরু করা সম্ভব যায়নি।’

[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা]