পরিবারের অভাব-অনটন দূর করতে বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন হবিগঞ্জের মো. সাজানুর রহমান। এক দালালের মাধ্যমে অবৈধভাবে ইতালির উদ্দেশে বাড়ি থেকে রওনা দেন। কিন্তু ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার আগে বিপদে পড়েন তিনিসহ এলাকার ৯ তরুণ। তাঁদের আটকে রেখে পরিবারের কাছে মুক্তিপণ চাইছে লিবিয়ার একটি চক্র।
ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা বলেন, চক্রের সদস্যরা তরুণদের বাড়িতে মুঠোফোনে যোগাযোগ করে সাড়ে আট লাখ টাকা করে দাবি করছেন। অন্যথায় তাঁদের হত্যা করে লাশ সাগরে ভাসিয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
জিম্মি থাকা হবিগঞ্জের ৯ জন অভিবাসনপ্রত্যাশীর মধ্যে ৪ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তাঁরা হলেন—হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ উপজেলার পশ্চিমবাগ গ্রামের সজলু মিয়ার ছেলে আফজল (২২), একই গ্রামের সেকুল মিয়ার ছেলে নাসির (২০) ও আবদুল মুকিত খানের ছেলে মো. সাজানুর রহমান (৩৫), জেলা শহরের নোয়াবাদ এলাকার সফর আলীর ছেলে উজ্জ্বল (২৭)।
সাজানুর রহমানের বাবা অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক আবদুল মুকিত খান বলেন, গত ফেব্রুয়ারিতে তাঁর ছেলে বাড়ি থেকে বের হন। হবিগঞ্জ শহরের নোয়াবাদ এলাকার বাসিন্দা বর্তমানে ত্রিপোলিতে বসবাসরত তৈমুর রহমানের মাধ্যমে ইতালি যাওয়ার কথা ছিল তাঁদের। প্রথমে তাঁরা মৌলভীবাজার জেলা সদরের মর্তুজা নামের এক দালালের মাধ্যমে লিবিয়ার বেনগাজি শহর পর্যন্ত পৌঁছান। পরে ছাবু মিয়া নামের আরেক দালাল তাঁদের ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি নিয়ে যাবেন বলে কথা ছিল। সবকিছু সমন্বয় করছিলেন তৈমুর রহমান। কিন্তু মাঝপথে ঘটে এসব অঘটন।
ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা আরও বলেন, দুই-তিন ধরে চার পরিবারের লোকজনের কাছে অপরিচিত মুঠোফোন নম্বর থেকে ফোন আসছে। তাঁরা সাড়ে আট লাখ টাকা করে দেওয়ার জন্য বলছে। তাঁরা বড়জোর এক মিনিট কথা বলেন। ফলে জিম্মি হওয়া ব্যক্তিদের সঠিক অবস্থান সম্পর্কে তাঁরা নিশ্চিত হতে পারছেন না। তবে তাঁরা লিবিয়াতেই আছেন, তা নিশ্চিত হওয়া গেছে। ফোন পাওয়ার পর থেকে তাঁদের আতঙ্কে দিন কাটছে। এ বিষয়ে কার কাছে তাঁরা সাহায্য চাইবেন, তা ভেবে পাচ্ছেন না তাঁরা।
আবদুল মুকিত খান বলেন, ছেলে সাজানুরকে অনেক অনুরোধ করেছিলেন এভাবে বিদেশে না যেতে। ছেলে কথা শোনেনি। আজ রোববার সকাল ৯টায় তাঁর ছেলে ফোন করেছিলেন। তখন সে জানান, এখনো তাঁরা আটকে আছেন। প্রত্যেকের জীবন হুমকিতে।
জিম্মি থাকা নাসির মিয়ার বাবা সেকুল মিয়া বলেন, তিনি নৌকা চালিয়ে সংসার চালান। তাঁর ছেলেকে ইতালি পাঠানোর জন্য নিজের শেষ সম্পদ জমিজমা বিক্রি করে ৯ লাখ টাকা দালালকে দিয়েছিলেন ইতালি নেওয়ার জন্য। এখন আরও সাড়ে আট লাখ টাকা দাবি করে তাঁকে মুঠোফোনে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। টাকা না দিলে ছেলেকে হত্যা করা হবে। এখন তিনি কী করবেন?
আফজলের বাবা সজলু মিয়া বলেন, ‘ছেলে পাঁচ মাস আগে বাড়ি থেকে বের হয়। বেনগাজি পৌঁছার পর একবার কথা হয়। তখন আমরা মনে করি কিছুদিনের মধ্যে ছেলে ইতালি পৌঁছাবে। কিন্তু তিন দিন আগে এক ফোন পেয়ে সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। অচেনা ফোন নম্বরে কে বা কারা আমাকে জানায়, আফজল ভূমধ্যসাগরে আটকা আছে। আরও সাড়ে আট লাখ টাকা না পাঠালে ছেলেকে কেটে সাগরে ভাসিয়ে দেবে। এর পর থেকে আমাদের পরিবারের ঘুম হারাম।’
এ বিষয়ে দালাল তৈমুর রহমানের মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তাঁর স্ত্রী জানান, তৈমুরের সঙ্গে বেশ কিছু দিন ধরে তাঁর কথা হয়নি। বিদেশে লোকজন পাঠানোর বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না।
আজমিরীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মর্তুজা হাসান জানান, তাঁর এলাকার তিনজন তরুণ ইতালি যেতে গিয়ে ভূমধ্যসাগরে এক চক্রের হাতে বন্দী আছেন এমন খবর তিনি পরিবারগুলোর কাছ থেকে পেয়েছেন। তিনি এ বিষয়ে তাঁদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছেন। পাশাপাশি স্থানীয় পুলিশ-প্রশাসনকে বিষয়টি জানানো হয়েছে।
আজমিরীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাসুক আলী প্রথম আলোকে বলেন, এখনো তাঁদের কাছে কেউ অভিযোগ নিয়ে আসেনি। তবে অপহরণের বিষয়টি তাঁরাও শুনেছেন।