আশ্রয় পেলেও খাবার পাননি মনসুররা, চেয়ে আছেন মানুষের সহায়তার দিকে

আশ্রয়কেন্দ্রে আসা মানুষেরা ভুগছেন খাবারের সংকটে। আজ শনিবার সকালে সিলেট নগরের মিরাবাজার এলাকার কিশোরী মোহন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে
ছবি: প্রথম আলো

পরিবারের ছয় সদস্য নিয়ে সিলেট নগরের মিরাবাজার এলাকার কিশোরী মোহন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন যুবক সৈয়দ এমরান। আজ শনিবার বেলা ১১টার দিকে তিনি হোটেলের কয়েকটি খাবারের প্যাকেট হাতে নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে ঢুকছিলেন। তিনি বলেন, রাতে সবাই শুকনা খাবার খেয়েছেন। সকালে কেউ কিছু খাননি। এ জন্য একসঙ্গে সকালের নাশতা এবং দুপুরের খাবার হিসেবে ভাত নিয়ে এসেছেন। ভ্যান চালিয়ে ২০০ টাকা জোগাড় করেছিলেন, তা দিয়েই খাবারগুলো এনেছেন।

এমরান তা–ও পরিবারের সদস্যদের জন্য কিছু খাবার জোগাড় করতে পেরেছেন। একই আশ্রয়কেন্দ্রে পরিবার নিয়ে দুদিন ধরে আশ্রয় নেওয়া মনসুর আলী (৭০) পড়েছেন আরও সংকটে। তিনি বলছিলেন, ‘দুই দিন ধরি বিল্ডিংঅ কোনোরকম আছি। ঘরে সব মালসামানা (মালামাল) পানির তলে। টাকাপয়সা যা রুজি করছি, ই কয় দিনে সব শ্যাষ। আশ্রয় পাইলেও খানি (খাবার) পাইরাম না। মানুষের কাছ তনে খুঁজিয়া চলরাম (চলছি)।’

সরকারের ত্রাণ না পৌঁছায় সামর্থ্যবানদের নিয়ে আসা খাবারই এখন ভরসা সিলেট নগরের আশ্রয়কেন্দ্রের বাসিন্দাদের। নগরের যতরপুর এলাকার মুকিত মিয়ার কলোনিতে বসবাস মনসুর মিয়ার। তিন ছেলেসহ পরিবারের পাঁচজন মিলে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন। রিকশা মেরামতের কাজ করা মনসুর আলী জানান, তাঁর বাড়ি সুনামগঞ্জে। বাড়িতে শুধু ভিটেমাটি আছে, আর কিছু নেই। এ জন্য জীবিকার তাগিদে প্রায় ৩০ বছর ধরে তিনি সিলেটে। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে তিনি আশ্রয়কেন্দ্রটিতে উঠেছেন। কিন্তু খাবারের সংকটে পরিবার-পরিজন নিয়ে রয়েছেন বিপাকে।

সিলেট সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত সিলেট নগরে সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে ৩০টি আশ্রয়কেন্দ্রে খোলা হয়েছিল। শনিবার সকাল থেকে আশ্রয়কেন্দ্রের হিসাব নেই। যে যেদিকে পারছেন, ছুটছেন। বাসিন্দারা যেখানে উঁচু জায়গা পাচ্ছেন, সেখানে অবস্থান করছেন। এর মধ্যে নগরের বেশ কয়েকটি ভবনের নিচতলায় পানি প্রবেশ করায় অনেকে দ্বিতীয় তলায় অবস্থান করছেন। সরকারের ত্রাণসহায়তা এখনো এসব আশ্রয়কেন্দ্রে পৌঁছায়নি।

কিশোরী মোহন সরকারি প্রাইমারি বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে আসা মাজেদা বেগমের (৬০) বাসা নগরের যতরপুর এলাকার মজিদ মিয়ার কলোনিতে। ঘরের সাত সদস্য নিয়ে তিনি আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন। ছেলে ভ্যান চালিয়ে আয়রোজগার করতেন। কিন্তু এখন বৃষ্টির মধ্যে ভ্যান চালাতে পারছেন না। মাজেদা বলেন, ছেলে আগে যা আয়রোজগার করেছেন, সেগুলো সব খরচ হয়ে গেছে। বৃষ্টি থামলে কেউ যদি কোনো সহযোগিতা নিয়ে আসেন, সে আশায় রয়েছেন তিনি।

আশ্রয়কেন্দ্রের সামনে চায়ের দোকান নিয়ে এসেছেন দিবা রানী দাশ। আজ শনিবার সকালে সিলেট নগরের মিরাবাজার এলাকায়

সকালে বাইরে যখন তুমুল বৃষ্টি হচ্ছিল, তখন আশ্রয়কেন্দ্রটির নিচে মিরাবাজার-শিবগঞ্জ সড়কে ভ্যানে চা-বিস্কুট নিয়ে বসেছিলেন দিবা রানী দাশ নামের এক নারী। তিনি বলেন, আগে সোবহানীঘাট মোড়ে তিনি চা বিক্রি করতেন। এখন বন্যার কারণে সেখানে বসতে পারছেন না। তাঁর মূল গ্রাহক নিম্ন আয়ের মানুষ। এখন আশ্রয়কেন্দ্রের পাশে দোকানটি নিয়ে এসেছেন, যাতে তাঁরাও উপকৃত হন, তিনিও বেচাকেনা করতে পারেন।
আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া আবদুল মানিক (৪৮) বলেন, আগে রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এখন প্রায় ছয় মাস ধরে টিউমার ধরা পড়ায় অসুস্থ। পরিশ্রম করতে পারেন না। স্ত্রী অন্যের বাসাবাড়িতে কাজ করে যা আয় করেন, তা দিয়ে সংসার চলে। বন্যায় শুক্রবার রাতে ভাড়াঘরে বুকপানি হওয়ায় চলে আসতে হয়েছে। এখন আশ্রয় পেলেও খাদ্যসংকটে রয়েছেন বলে জানান তিনি।

সিলেট সিটি করপোরেশনের বিদ্যুৎ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী (আশ্রয়কেন্দ্রের অতিরিক্ত দায়িত্ব) রুহুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে কতজন রয়েছে, সেটি বলা যাচ্ছে না। এখন সব কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। খাবার সরবরাহ এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে হয়নি। কিন্তু যে যেভাবে পারছেন, সহযোগিতা করছেন। এর বাইরে জনপ্রতিনিধিরাও এগিয়ে আসছেন। সরকারিভাবে ৩০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ পাওয়া গেছে, কিন্তু বৃষ্টির মধ্যে সেগুলোও আনা হয়নি।

রুহুল আলম বলেন, ‘আমরা আগে ৩০টি আশ্রয়কেন্দ্র ঘোষণা করেছিলাম। এখন মানুষজন যে যেদিকে পারছেন, নিরাপদ আশ্রয়ে উঠছেন। আবার অনেক বাসাবাড়ির বহুতল ভবন হলেও নিচের তলাগুলোতে পানি প্রবেশ করায় ওপরের তলায় আশ্রয় নিচ্ছেন।’