সেই যে ১০ বছর বয়স থেকে গাছ লাগানো শুরু করেছিলেন, আজ ৮০ বছর বয়সে এসেও তা অব্যাহত রেখেছেন বৃক্ষপ্রেমী কার্তিক পরামানিক। বর্ষাকাল এলেই যেন নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেন না। নিজের নার্সারিতে তৈরি চারা নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। এরপর গাছ লাগান সরকারি জমি, রাস্তাঘাট ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের সীমান্তবর্তী গ্রাম শিবগঞ্জ উপজেলার মনাকষা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) তারাপুর গ্রামের বাসিন্দা কার্তিক পরামানিক প্রতিবছর নিজের জমানো টাকা খরচ করে বেশ কয়েকজন শ্রমিক সঙ্গে নিয়ে কয়েক শ গাছ লাগান। তবে এবার করোনাকালে কলেজশিক্ষক ছেলে ও গ্রামের শিশুদের নিয়ে গত বুধবার হঠাৎপাড়ার রাস্তার পাশে কয়েকটি গাছ লাগিয়েছেন। তাঁর আগে এলাকার লোকজনদের ২০০ আতা ফলের গাছ দিয়েছেন বিনা মূল্যে।
‘গয়া-কাশী গিয়ে তীর্থ করে যে পূণ্য হবে, তার থেকে ছায়াবৃক্ষ লাগিয়ে অনেক বেশি পূণ্য পাওয়া যাবে। সেই বৃক্ষের ছায়ায় মানুষের প্রাণ জোড়াবে। পাখপাখালির আশ্রয় হবে’—গল্প বলার সময় কার্তিক পরামানিককে এমনটাই বলেছিলেন তাঁর বাবা। ছোটবেলায় শোনা সেই কথা গেঁথে যায় তাঁর মনে। ১০ বছর বয়সে শুরু হয় তাঁর গাছ লাগানো। এলাকায় বট-পাকুড়সহ বিভিন্ন বিরাট বিরাট গাছ এখন কালের সাক্ষী হয়ে, একেকটি কার্তিকনামা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
গাছ লাগানোর ৫৩ বছর পর কার্তিক পরামানিককে খুঁজে পায় প্রথম আলো। তাঁকে নিয়ে ২০০৩ সালের ২ ডিসেম্বর প্রথম আলোর প্রথম পাতায় ‘বিশাল বিশাল বৃক্ষগুলো একেকটি কার্তিকনামা’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। এরপর ২০০৬ সালে তাঁকে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে কৃষি পদক দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যোগাযোগ উপদেষ্টা তাঁকে বলেন, ‘আপনি কী চান?’ কার্তিক পরামানিক তাঁর এলাকার রাস্তা পাকা করে দেওয়ার দাবি জানান। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৭ সালে মনাকষার হঠাৎপাড়া থেকে কার্তিক পরামানিকের বাড়ি পর্যন্ত প্রায় সাত কিলোমিটার রাস্তা পাকা করে দেওয়া হয়। এ রাস্তায় প্রায় চার কোটি টাকা ব্যয়ে একটি সেতুও নির্মাণ করা হয়েছে।
কার্তিক পরামানিক বলেন, ‘প্রথম আলোতে প্রতিবেদন প্রকাশের পর সারা দেশের মানুষ আমার কথা জানতে পেরেছে। জীবনে অনেক সম্মান, পদক ও পুরস্কার পেয়েছি। সবচেয়ে বড় পুরস্কার হচ্ছে ২০১৩ সালে অষ্টম শ্রেণির ইংরেজি পাঠ্যবইয়ে ‘‘আ ম্যান হু লাভ ট্রিজ”শিরোনামে কাহিনি ছাপিয়েছে। সেখানে সূত্র হিসেবে ২ ডিসেম্বরের প্রথম আলোর কথা উল্লেখ করা আছে। সারা দেশের ছাত্রছাত্রী আমার গাছ লাগানোর গল্প পড়েছে। জীবনে এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে!’
কার্তিক পরামানিকের এ গাছ লাগানো সম্পর্কে স্থানীয় তারাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল হামিদ (৫২) বলেন, ‘শিশুকাল থেকেই তাঁকে গাছ লাগাতে দেখে আসছি। আমি যে বিদ্যালয়ে পড়েছি (তারাপুর উচ্চবিদ্যালয়), সেখানে তাঁর লাগানো গাছের ছায়ায় সময় কাটিয়েছি। খেলাধুলা করেছি। শুধু ওই বিদ্যালয় নয়, এলাকায় যত স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা রয়েছে; তার সবগুলোতেই কার্তিক পরামানিক অসংখ্য গাছ লাগিয়েছেন।’
আবদুল হামিদ বলেন, কার্তিক পরামানিকের লাগানো বিরাট বিরাট গাছ কেটে বিক্রির টাকা দিয়ে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উন্নয়নকাজ হয়েছে। এমন ঘটনাও আছে যে রাস্তার পাশে গাছ লাগাতে গিয়ে কোনো গরিব মানুষের জমিতেও গাছ লাগিয়েছেন। সেই গাছ বিক্রি করে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন ওই গরিব মানুষ। তিনি আরও বলেন, ‘এলাকায় আমার দেখা সবচেয়ে ভালো মানুষ তিনি। কেননা একজন গরিব নরসুন্দর হয়েও নিজের খরচে গাছ লাগিয়েছেন। গাছের পরিচর্যা করেছেন। সন্তানদের লেখাপড়া শিখিয়েছেন।’
মনাকষা ইউপির ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য সামির উদ্দিন জানান, এলাকার যত সরকারি রাস্তা, মোড়, হাটবাজার, বিজিবি ক্যাম্প, ঈদগাহে বিরাট গাছ দেখা যায়; তার সবই কার্তিক পরামানিকের লাগনো। তাঁর লাগানো গাছতলায় দোকানপাট ও বাজারও বসেছে। তাঁর জন্যই এ সীমান্তবর্তী প্রত্যন্ত এলাকায় পাকা রাস্তা হয়েছে।
একই ইউপির বাসিন্দা চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ (শিবগঞ্জ) আসনের সাংসদ সামিল উদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘তিনি এলাকার গর্ব। একজন সম্মানিত ব্যক্তি। নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তির উদাহরণ দিতে গিয়ে তাঁর কথা বলি। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তাঁর জন্য রাস্তা হয়েছে। সেই রাস্তা বেহাল। সংস্কারের জন্য চেষ্টা করে বরাদ্দ করিয়েছি সাড়ে তিন কোটি টাকা। দরপত্র হয়ে কার্যাদেশও দেওয়া হয়েছে তিন মাস আগে। তবে ঠিকাদার এখনো কাজ শুরু করেনি।’