আরিফুল-বিরোধী নেতারা খুশি, সাধারণ কর্মীরা হতাশ

বিএনপির লোগো
বিএনপির লোগো

বিএনপির উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে সিলেট জেলা বিএনপির আসন্ন সম্মেলনে সভাপতি পদের প্রার্থিতা থেকে গতকাল মঙ্গলবার নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। এর পর থেকে এ নিয়ে সিলেট বিএনপিতে চলছে নানামুখী আলোচনা-সমালোচনা।

বিএনপির তৃণমূলের একাধিক কর্মী বলছেন, মাঠপর্যায়ে কর্মীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকলেও স্থানীয় পর্যায়ে দলের প্রভাবশালী অনেক নেতার সঙ্গে আরিফুল হক চৌধুরীর দূরত্ব আছে। আরিফুলের প্রার্থিতা প্রত্যাহারের বিষয়ে ওই প্রভাবশালী মহল দলের উচ্চপর্যায়কে প্রভাবিত করেছে। এমন দুঃখজনক উদাহরণ তৈরি হওয়ায় দলে অগণতান্ত্রিকচর্চা বাড়বে। এতে আরিফুল-বিরোধী নেতারা খুশি হলেও তৃণমূলের অধিকাংশ সাধারণ কর্মীরা হতাশ হয়েছেন।

সিলেট সদর, দক্ষিণ সুরমা ও গোয়াইনঘাট উপজেলার বিএনপির ইউনিয়ন পর্যায়ের একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, সম্মেলনে প্রত্যক্ষ ভোটে সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচন করা হবে। সে অনুযায়ী আরিফুল প্রার্থীও হয়েছিলেন। কর্মীবান্ধব জনপ্রিয় নেতা হিসেবে পরিচিত আরিফুলকে কেন্দ্র থেকে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের অনুরোধ জানানোর বিষয়টি একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।

জেলা বিএনপির এক নেতা জানিয়েছেন, আরিফুল যদি সভাপতি নির্বাচিত হন, তাহলে জেলার রাজনীতি পুরোপুরি আরিফুলের নিয়ন্ত্রণে চলে যেতে পারে, এমন আশঙ্কায় আরিফুল-বিরোধীরা শুরু থেকেই তাঁকে আটকাতে একাট্টা ছিলেন। আরিফুল প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেওয়ায় তাই তাঁরা এখন ফুরফুরে মেজাজে আছেন। যদিও প্রকাশ্যে এ নিয়ে কেউ কোনো কথা বলছেন না। তবে তৃণমূলের কর্মীরা বিষয়টি ভালোভাবে নেননি। আরিফুলের প্রতি বিদ্বেষমূলক এমন আচরণ ভবিষ্যতে সিলেট বিএনপির রাজনীতিতে দ্বন্দ্ব-রেষারেষি আরও বাড়াবে বলে আশঙ্কা আছে।

তবে গতকাল দুপুরে জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়ার পর থেকে আরিফুল হক চৌধুরী একেবারেই চুপচাপ আছেন। এ নিয়ে তিনি কোনো কথা বলছেন না। আজ বুধবার বেলা দেড়টার দিকে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘এ নিয়ে আমি নতুন করে আর কোনো কথা বলতে চাই না। দল করি, তাই দলের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছি। এতে আমার কোনো খেদ নেই। দল যখন যেভাবে আমাকে চাইবে, সেভাবেই দলের প্রয়োজনে কাজ করব। রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার পর থেকেই আমি দলের জন্য নিবেদিতপ্রাণ।’

জেলা বিএনপির একটি সূত্রে জানা গেছে, গত সোমবার জেলা বিএনপির সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল। এ সম্মেলনে শীর্ষ তিন পদে সরাসরি ভোটে নেতৃত্ব নির্বাচনেরও ঘোষণা দেওয়া হয়। তিন পদে ১৩ জন নেতা মনোনয়ন ফরম জমা দেন। সভাপতি পদে প্রার্থী হন আরিফুল হক চৌধুরী, জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি আবুল কাহের চৌধুরী ও যুবদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সহসভাপতি আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী। তবে এক দিন আগে হঠাৎ করেই কেন্দ্র থেকে সম্মেলন স্থগিত করা হয়। সম্মেলনের ভোটার তালিকা প্রস্তুতে ‘অনিয়ম’ হয়েছে বলে তখন কেন্দ্র থেকে জানানো হয়। তবে এর দুই দিন পর চলতি মাসেই সম্মেলন আয়োজনের পুনঃসিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

বিএনপির একাধিক নেতা প্রথম আলোকে বলেন, একসময় সিলেট বিএনপির একক নেতা ছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান। ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক এম ইলিয়াস আলীর উত্থানে সিলেট বিএনপিতে দুটি ধারা তৈরি হয়। সাইফুর বলয়ের শীর্ষস্থানীয় নেতা ছিলেন আরিফুল। সাইফুরের মৃত্যু এবং ইলিয়াস গুম হওয়ার পরও এ বিভেদ কাটেনি। বরং নানা উপদল বা গ্রুপ তৈরি হয়ে রেষারেষি আরও বেড়েছে।

আরিফুল হক চৌধুরী ২০০৭ সালে এক-এগারোর পটপরিবর্তনের পর গ্রেপ্তার হন। পরে মুক্তি পেলেও দলে কোণঠাসা ছিলেন। তবে বিএনপির মনোনয়নে গত দুটি সিটি নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হন। ২০১৬ সালে তাঁকে দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য করা হয়। এদিকে আরিফুল ছিটকে পড়ার পর সিলেট বিএনপিতে ধীরে ধীরে প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার আবদুল মুক্তাদির। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাঁকে সিলেট-১ (মহানগর ও সদর) আসনে প্রার্থী করে বিএনপি।

প্রভাবশালী এ দুই নেতার দীর্ঘদিনের ভেতরকার দ্বন্দ্ব সম্মেলন সামনে রেখে সম্প্রতি প্রকাশ্য রূপ নেয়।
বিএনপির একটি সূত্র জানিয়েছে, সিলেট জেলা বিএনপির সম্মেলনে সভাপতি পদে প্রার্থী হওয়া আবুল কাহের চৌধুরী স্থানীয় রাজনীতিতে খন্দকার আবদুল মুক্তাদির বলয়ের নেতা হিসেবে পরিচিত। তাই মুক্তাদির নিজের বলয়ের নেতার সভাপতি পদ নিশ্চিত করতেই উচ্চপর্যায়কে প্রভাবিত করে আরিফুলের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করিয়েছেন। তবে আরিফুল প্রার্থিতা প্রত্যাহার করলেও আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী এখানে সভাপতি হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। বিএনপির ‘নিখোঁজ’ নেতা এম ইলিয়াস আলী বলয়ের বৃহৎ একটা অংশ তাঁর পাশে আছে। এর ফলে সভাপতি পদে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস আছে।

খন্দকার আবদুল মুক্তাদির দেশের বাইরে থাকায় তাঁর বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। তবে আরিফুলের প্রার্থিতা প্রত্যাহার প্রসঙ্গে সিলেট জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কামরুল হুদা জায়গীরদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘উনি (আরিফুল) নিজেই প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছেন। এতে তৃণমূলে কোনো নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়নি। এমন কোনো বিষয় আমার কানেও আসেনি। সম্মেলন সুষ্ঠুভাবে আয়োজনে আমরা চেষ্টা করছি। ২৯ মার্চ সম্মেলন আয়োজনের সম্ভাব্য তারিখ প্রাথমিকভাবে পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। মোট ১ হাজার ৮১৮ জন কাউন্সিলর ভোট দিয়ে শীর্ষ তিন পদে নেতৃত্ব নির্বাচন করবেন।’