কক্সবাজার শহর থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে উখিয়ার থাইনখালী (ক্যাম্প-১৮) রোহিঙ্গা শিবির। শিবিরের মাঝামাঝি একটি সড়কের পাশে টিনের ছাউনি দেওয়া একটি মাদ্রাসা। মাদ্রাসার পাশে একটি মসজিদ। মাদ্রাসা ও মসজিদটি পরিচালনা করে ‘ ইসলামী মাহাস’ নামের রোহিঙ্গাদের একটি সংগঠন। গতকাল বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত সাড়ে তিনটায় ওই মাদ্রাসায় হামলা চালায় ৪০ থেকে ৫০ জন সশস্ত্র সন্ত্রাসী। সন্ত্রাসীদের এলোপাতাড়ি গুলি ও ধারালো অস্ত্রের আঘাতে ছয়জন নিহত ও ১২ জন আহত হয়েছে।
হামলার ঘটনায় মিয়ানমারের সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ‘ আরাকান স্যালভেশন আর্মি’–আরসাকে (আল ইয়াকিন নামেও পরিচিত) দায়ী করছেন রোহিঙ্গা নেতারা। কারণ, বাংলাদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়া–না যাওয়া (প্রত্যাবাসন) নিয়ে ইসলামী মাহাস নেতাদের সঙ্গে আরসার বিরোধ চলে আসছিল। তবে পুলিশ বলছে, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে আরসা বা আল ইয়াকিনের কেনো অস্তিত্ব নেই।
‘দারুল উলুম নাদওয়াতুল ওলামা আল-ইসলামিয়া’ নামের ওই মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক মৌলভি দিন মোহাম্মদ বলেন, দিবাগত রাত সাড়ে তিনটায় মাদ্রাসার শিক্ষক-ছাত্র মিলে অন্তত ২৫ জন মসজিদে তাহাজ্জুতের নামাজ পড়তে যান। এ সময় অস্ত্রধারীরা মসজিদে ঢুকে এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকে। মসজিদের বাইরে পাহারায় ছিল আরও ৪০ জনের বেশি মুখোশধারী সন্ত্রাসী। গুলির আওয়াজ শুনে সাধারণ রোহিঙ্গা এবং শিবিরের রোহিঙ্গা নেতারা এগিয়ে এলে তাঁদের লক্ষ্য করেও গুলি চালানো হয়।
হামলায় নিহত ব্যক্তিরা হলেন ‘দারুল উলুম নাদওয়াতুল ওলামা আল-ইসলামিয়া’ মাদ্রাসার শিক্ষক ও বালুখালী ২ নম্বর শিবিরের বাসিন্দা মোহাম্মদ ইদ্রিস (৩২), বালুখালী-৯ নম্বর শিবিরের ব্লক-২৯–এর বাসিন্দা ইব্রাহীম হোসেন (২২), বালুখালী ১৮ নম্বর ক্যাম্পের এইচ ব্লকের বাসিন্দা ও স্বেচ্ছাসেবক আজিজুল হক (২৬) ও মোহাম্মদ আমিন (৩২), একই মাদ্রাসার শিক্ষক ও বালুখালী-১৮ নম্বর শিবিরের, ব্লক-এফ-২২–এর নুর আলম ওরফে হালিম (৪৫) এবং মাদ্রাসাশিক্ষক ও ২৪ নম্বর শিবিরের হামিদুল্লাহ (৫৫) । এর মধ্যে প্রথম চারজন ঘটনাস্থলেই এবং অপর দুইজনকে উখিয়ার এমএসএফ হাসপাতালে নেওয়ার পর মৃত ঘোষণা করা হয়।
প্রথমে রোহিঙ্গা শিবিরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আট আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন এই হামলায় সাতজন নিহত হওয়ার কথা বলেছিল। কিন্তু পরে তারা জানিয়েছে ওই হামলায় ছয়জন নিহত হয়েছে। আগে ওই হামলায় মাদ্রাসাছাত্র ও ১৮ নম্বর শিবিরের ব্লক এইচ-৫২–এর বাসিন্দা নুর কায়সার (১৫) নিহত বলা হয়েছিল| আসলে তাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মাদ্রাসার আশপাশে থাকা কয়েকজন রোহিঙ্গা জানান, গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে উখিয়ার লাম্বাশিয়া আশ্রয়শিবিরের ডি ব্লকে ‘আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) কার্যালয়ে ওই সংগঠনের চেয়ারম্যান মুহিবুল্লাহ (৪৮) বন্দুকধারীদের গুলিতে নিহত হন। আরসা নেতা আবদুর রহিমের নেতৃত্ব ২০ থেকে ২৫ জন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী ওই হামলা চালিয়েছিল। এ পর্যন্ত মুহিবুল্লাহ হত্যার সঙ্গে জড়িত আরসার ৫ জন সদস্য ও ৪০ জনের বেশি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার হয়েছে। আরসা সদস্যদের আটকের বিষয়ে পুলিশকে তথ্য দিয়ে ইসলামী মাহাসের সদস্যরা সহযোগিতা করেছেন—এই ধারণা থেকে ওই মাদ্রাসা-মসজিদে হামলা চালানো হয়।
রোহিঙ্গাদের ভাষ্য, মসজিদ-মাদ্রাসায় হামলার ঘটনায় ছয় রোহিঙ্গা খুনের ঘটনায় আরসা জড়িত। মসজিদ-মাদ্রাসাটি দখলের জন্য এর আগেও কয়েকবার হামলা চালিয়েছিলেন আরসা সদস্যরা।
রোহিঙ্গা শিবিরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আট আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক ও পুলিশ সুপার শিহাব কায়সার খান প্রথম আলোকে বলেন, সন্ত্রাসীদের গুলিতে ছয়জন রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে। ময়নাতদন্তের জন্য লাশগুলো কক্সবাজার সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে। হামলার কারণ, কারা হামলা করেছে—সেসব ব্যাপারে কিছুই জানা যায়নি। এ ঘটনায় মুজিবুর রহমান নামের একজন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীকে অস্ত্রসহ আটক করা হয়েছে।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, রোহিঙ্গা শিবিরে মিয়ানমারের সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরসা অথবা আল ইয়াকিন নামের কোনো সংগঠনের তৎপরতা নেই। তবে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা আরসা এবং আল ইয়াকিনের নাম ব্যবহার করে অপতৎরতা চালাচ্ছে। ইতিমধ্যে তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে আগ্নেয়াস্ত্রসহ আটক করা হয়েছে। অন্যদের ধরতে ওই শিবিরে সাঁড়াশি অভিযান চালানো হচ্ছে।
আজ দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মামুনুর রশীদ, শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) শাহ নেওয়াজ হায়াত। তবে তাঁরা এ হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি।