‘মা, টিভি বন্ধ কোরো না’ বলে বাসা থেকে বেরিয়ে যায় জুবায়ের। সাত বছরের শিশুটি বাবার সঙ্গে বাড়ির কাছের মসজিদে যাবে নামাজ আদায়ে। ফিরে এসে আবার বসে যাবে টিভির সামনে। তাই টিভি বন্ধ করেননি মা। মিনিট বিশেক পরই মা জানতে পারেন সেই হৃদয়বিদারী খবর, তাঁর নাড়িছেঁড়া বুকের মানিক আর টিভি দেখতে আসবে না। একমাত্র সন্তান কখনোই আর ফিরবে না বাসায়।
নারায়ণগঞ্জ শহরের পশ্চিম তল্লা এলাকায় গতকাল শুক্রবার মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় এ পর্যন্ত মারা যাওয়া ১৪ জনের মধ্যে নাম আছে জুবায়েরেরও। বিস্ফোরণের পর জুবায়েরের মা রাহিমা খাতুন জানতে পারেন, তাঁর ছেলে যে মসজিদে নামাজ আদায় করতে গেছে, সেখানে আগুন লেগেছে। পাগলের মতো মসজিদের দিকে ছুটে যান। গিয়ে দেখেন, মসজিদ বিধ্বস্ত। সেখানে লুটিয়ে পড়েছে তাঁর স্বপ্নসাধ।
ঘটনাস্থলে গিয়ে মা রাহিমা জানতে পারেন, তাঁর ছেলে আর স্বামীকে নারায়ণগঞ্জের ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন, এই হাসপাতাল থেকে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে ঢাকায়। ভর্তি করা হয়েছে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। রাত ১০টার পর রাহিমা আসেন ঢাকায়।
তখন আগুনে পুড়ে যাওয়া আদরের সন্তান জুবায়ের আর স্বামীকে দেখতে পান।
ছেলে জুবায়েরের সঙ্গে কথা বলেন মা। মায়ের দেওয়া এক ঢোঁক পানি পান করে জুবায়ের। এরপর রাত একটার দিকে মারা যায়। জুবায়েরের বাবা জুলহাস মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। জুবায়ের মা-বাবার সঙ্গে নারায়ণগঞ্জে থাকত। তার বাবা জুলহাস ফরাজি নারায়ণগঞ্জে পোশাক কারখানায় চাকরি করতেন।
একমাত্র সন্তানের লাশ নেওয়ার জন্য মা শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সামনে বসে আছেন। রাহিমা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার বুকের ধন আমাকে ছেড়ে কোথায় চলে গেল? আমার সোনার সংসার তছনছ হয়ে গেল।’ কে দেবে এই প্রশ্নের উত্তর। কে দেবে তাঁকে সান্ত্বনা না?
স্নাতক পাস মোস্তফা কামালের বয়স ৩৪ বছর। গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরে। ১৫ দিন আগে চাঁদপুর থেকে তিনি নারায়ণগঞ্জ যান। সেখানে টিউশনি করতেন। চাকরির জন্য চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু চাকরি পাননি মোস্তফা কামাল। বছর দেড়েক আগে তিনি বিয়ে করেন। স্ত্রী চাঁদপুরে থাকতেন, শ্বশুরবাড়ি। বৃদ্ধ বাবা করিম মিঝিকে কথা দিয়ে এসেছিলেন, চাকরি হলে স্ত্রীকে নারায়ণগঞ্জ নিয়ে আসবেন। কিন্তু মোস্তফা কামাল বিস্ফোরণের ঘটনায় পুড়ে মারা গেছেন। ছেলের এমন মৃত্যুর খবর পেয়ে বাবা করিম মিঝি চাঁদপুর থেকে ঢাকায় এসেছেন। হাসপাতালের নিচতলায় চেয়ারে চুপচাপ বসে ছিলেন করিম মিঝি।
করিম মিঝি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ছেলে লকডাউনে চার মাস বাড়িতে ছিল। ১৫ দিন আগে নারায়ণগঞ্জ এসেছে। মেসে থেকে ছেলেপেলে পড়াত। অনেক দিন ধরে চাকরির চেষ্টা করে যাচ্ছিল। কিন্তু চাকরি আমার ছেলে পায়নি।’ হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বাবা করিম মিঝি বলেন, ‘আমার ছেলে আর চাকরি পেল না। আর চাকরির জন্য চেষ্টা করবে না আমার ছেলে।’
করিম মিঝি একসময় কারখানায় চাকরি করতেন। তিন ছেলের মধ্যে মোস্তফা কামাল বড় ছিল। অনেক কষ্টে তিনি ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। কেবল মোস্তফা নন, নারায়ণগঞ্জ শহরের পশ্চিম তল্লা এলাকায় মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় এ পর্যন্ত মারা গেছেন ১২ জন। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে এখন কেবলই স্বজনের আহাজারি আর কান্নার শব্দ।
মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় পুড়ে মারা গেছেন দুই ভাই সাব্বির (২১) ও জুবায়ের (১৮)। সঙ্গে থাকা আরেক ভাই ইয়াসিন ফরজ নামাজ আদায় শেষে মসজিদ থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। এর কিছুক্ষণ পর বিস্ফোরণ ঘটে। দুই ছেলের মৃত্যুর খবর দুপুর ১২টার দিকে জানতে পারেন বাবা নূর উদ্দিন আর মা কুলসুম বেগম। হাসপাতালে দুই ছেলে হারানো মা–বাবা চিৎকার করে কাঁদছিলেন। মা কুলসুম বেগম বলেন, ‘আমাদের কী হয়ে গেল...!’
নারায়ণগঞ্জ শহরের পশ্চিম তল্লা এলাকায় গতকাল রাত সাড়ে আটটার দিকে বায়তুস সালাত জামে মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় প্রায় অর্ধশত মানুষ দগ্ধ হয়েছেন। দগ্ধ ব্যক্তিদের উদ্ধার করে স্থানীয় হাসপাতাল ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে, মসজিদের সামনের গ্যাসের লাইনের লিকেজ থেকে এই বিস্ফোরণ ঘটে থাকতে পারে। এ পর্যন্ত ১৪ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।