‘মারে, আমারে ছেড়ে কেন চলে গেলি। আমি কারে মা ডাকমু। আমারে খালি কইরা তরা থুইয়্যা গেলি রে মা।’ নিখোঁজের তিন দিন পর সাড়ে তিন বছর বয়সী মেয়ে আরোহী রাজবংশীর লাশ পেয়ে গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে শহরের আল আমিননগর এলাকায় নদীর তীরে বিলাপ করছিলেন বাবা জয়রাম রাজবংশী। তিনি মুন্সিগঞ্জ জেলার ইসমানিরচর এলাকার বাসিন্দা।
গতকাল সকালে সিদ্ধিরগঞ্জের হরিপুর এলাকা থেকে শিশু আরোহী রাজবংশী এবং মদনগঞ্জ এলাকা থেকে লঞ্চডুবির নিখোঁজ আবদুল্লাহ আল জোবায়েরের (৩০) লাশ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস ও নৌ পুলিশ। এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক আবদুল্লাহ আরেফিন বলেন, গত রোববার দুপুরে শীতলক্ষ্যা নদীতে যাত্রীবাহী লঞ্চ এম এল আফসার উদ্দিন ডুবে যাওয়ার ঘটনায় এ নিয়ে ১০ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনায় নিখোঁজ আরও দুজন।
লঞ্চডুবির ঘটনায় জয়রাম রাজবংশীর দুই মেয়ে কলেজশিক্ষার্থী স্মৃতি রাজবংশী ও আরোহী রাজবংশীর মৃত্যু হয়। স্মৃতি রাজবংশী মুন্সিগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজের উচ্চমাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিল। দুই মেয়েকে হারিয়ে মা শিখা রানী রাজবংশী এখন পাগলপ্রায়। তিনি বাড়িতেই আছেন।
জয়রাম রাজবংশী আক্ষেপ করে বলেন, গত শুক্রবার হোলি উৎসবের জন্য বন্দর উপজেলার এশরামপুর এলাকায় মাসির বাড়িতে বেড়াতে যায় দুই বোন। আরোহীকে ছাড়া বাড়িতে ভালো লাগছিল না। তাই তাড়াতাড়ি বাড়িতে আসতে বলেছিলেন। মেয়েদের বারবার বলেছিলেন ট্রলারে করে আসতে। তাঁর কথা না শুনে মেয়েরা কেন মুন্সিগঞ্জের লঞ্চে উঠল? এ সময় তিনি কান্নায় ভেঙে পড়ে বলেন, ‘আমার কথাটা একটু শুনলি না রে মা। কী করলি তোরা রে মা। আমারে খালি কইরা থুইয়্যা গেলি রে মা। আমার খালি কুইরা থুইয়্যা গেলি রে মা।’
এর আগে আবদুল্লাহ আল জোবায়েরের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তাঁর বাড়ি চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার বিষকাঁঠালী এলাকায়। তিনি রাজধানীর ডেমরা এলাকায় থাকতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করার পর রাজধানীতে একটি তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন তিনি। বড় ভাই আবদুল্লাহ মাহমুদ বলেন, তাঁর ভাই বন্ধুদের সঙ্গে লঞ্চে ঘুরতে যাওয়ার পথে নিখোঁজ হন। তিন বন্ধু দুর্ঘটনার পর লাফিয়ে পড়ে প্রাণে বাঁচলেও তাঁর ভাই নিখোঁজ ছিলেন।
জোবায়েরের মামা জার্সি চৌধুরী বলেন, জোবায়ের সাঁতার জানতেন না। বন্ধুরা লাফিয়ে পড়ে প্রাণে বাঁচলেও তিনি সাঁতার না জানায় বাঁচতে পারেননি।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, গত রোববার বেলা আড়াইটার দিকে নারায়ণগঞ্জে শীতলক্ষ্যা নদীর সোনাকান্দা এলাকায় যাত্রীবাহী লঞ্চ এম এল আফসার উদ্দিন-২-কে চাপা দিয়ে ডুবিয়ে পালিয়ে যায় কার্গো জাহাজ রূপসী-৯। লঞ্চে থাকা অর্ধশতাধিক যাত্রীর অনেকে সাঁতরে উঠতে সক্ষম হলেও নিখোঁজ ছিলেন অনেকে। এ ঘটনায় কার্গো জাহাজ রূপসী-৯ জব্দ করে এবং ওই কার্গোর মাস্টারকে আটক করে নৌ পুলিশ। এদিকে লঞ্চডুবির ঘটনায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট শামীম ব্যাপারীকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন। এ ছাড়া নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব বজলুর রশিদকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।