আমানত খোয়ানোর শঙ্কায় কয়েক হাজার মানুষ

প্রায় শতকোটি টাকার সঞ্চয় আমানত নিয়েছিল এহসান গ্রুপ। দুই বছর আগে তারা লভ্যাংশ দেওয়া বন্ধ করে দেয়।

পিরোজপুর জেলার মানচিত্র

লভ্যাংশ দেওয়ার কথা বলে পিরোজপুরে ১০ হাজার মানুষের কাছ থেকে প্রায় শতকোটি টাকা সঞ্চয় আমানত নিয়েছিল এহসান গ্রুপ নামের একটি অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান। দুই বছর আগে প্রতিষ্ঠানটি হঠাৎ আমানতকারীদের লভ্যাংশ দেওয়া বন্ধ করে দেয়। এরপর আমানতকারীরা টাকা ফেরত চাইলে প্রতিষ্ঠানের মালিক রাগীব আহসান গা ঢাকা দেন। কয়েক হাজার গ্রাহক টাকা ফেরত পেতে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা ও স্থানীয় প্রশাসনের কাছে ধরনা দিয়েও কোনো লাভ হচ্ছে না।

অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পিরোজপুরের জেলা প্রশাসক ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশে সমবায় অধিদপ্তরের যুগ্ম রেজিস্ট্রার মৃণাল কান্তি বিশ্বাস তদন্ত করে এহসান গ্রুপের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পান। তবে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া বা আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়ার কোনো উদ্যোগ নেয়নি প্রশাসন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির এহসান মাল্টিপারপাস কো–অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড, এহসান সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি লিমিটেড, ডেফোডিল মাল্টিপারপাস কো–অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড, এহসান বেসিক সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি লিমিটেড এবং এহসান রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড বিল্ডার্স লিমিটেডের নামের পাঁচটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর নামে আমানত সঞ্চয়ের কথা বলে গ্রাহকের কাছ থেকে ১০ বছর ধরে টাকা নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া এহসান গ্রুপের ক্যাডেট একাডেমি, গার্মেন্টস ও প্রসাধনসামগ্রীর ব্যবসা, স্যানিটারি ও হার্ডওয়্যার ব্যবসা, মহিলা মাদ্রাসাসহ ১৭টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বর্তমানে এসব প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগের অস্তিত্ব নেই।

২০০৮ সাল থেকে অধিক মুনাফা দেওয়ার কথা বলে সঞ্চয় আমানত নিয়ে এহসান গ্রুপ ব্যবসা করে আসছিল। প্রতিষ্ঠানটি ১ হাজার ২০০ ব্যক্তিকে সদস্য (কর্মী) হিসেবে নিয়োগ দেয়। এই সদস্যরা প্রতি এক লাখ টাকা আমানতের বিপরীতে মাসে ২ হাজার টাকা লভ্যাংশ দেওয়ার কথা বলে প্রায় শতকোটি টাকা সংগ্রহ করেন। পিরোজপুর ও পাশের ঝালকাঠি, বাগেরহাট জেলার ১০ হাজার ব্যক্তি এ প্রতিষ্ঠানে টাকা আমানত রাখেন। দুই বছর আগে রাগীব আহসানের হাজতবাসের খবরে সদস্যদের মধ্যে আমানত খোয়ানোর আশঙ্কা দেখা দেয়। এর কিছুদিন পর ২০১৯ সালের জুলাই মাস থেকে প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকদের মাসিক মুনাফা ও আমানতের টাকা ফেরত দেওয়া বন্ধ করে দেয়।

পিরোজপুর সদর উপজেলার দুর্গাপুর চুঙ্গাপাশা মাদ্রাসার উপাধ্যক্ষ এখলাছুর রহমান বলেন, ‘আমি এহসান গ্রুপের কর্মী ছিলাম। আমার মাধ্যমে ৬২ জন ব্যক্তি ৬৫ লাখ টাকা আমানত রাখেন। দুই বছর ধরে আমানতকারীরা মাসিক মুনাফা না পেয়ে আমানতের টাকাও ফেরত চাচ্ছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ টাকা ফেরত দিচ্ছে না।’

পিরোজপুর পৌরসভার ব্রাহ্মণকাঠি গ্রামের আলী আকবর বলেন, ‘আমার মাধ্যমে ৫৮০ জন ব্যক্তি এহসান গ্রুপে ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা আমানত রেখেছিল। আমানতকারীদের টাকা এহসান গ্রুপ ফেরত না দেওয়ায় তাঁরা আমাকে চাপ দিচ্ছেন।’

আমানতকারীরা জানান, সঞ্চয় করা টাকা ৫৪ মাস পর শতকরা ২৫ ভাগ ও আট বছর পর দ্বিগুণ মুনাফা দেওয়া এবং আমানতকারীকে প্রতি লাখে প্রতি মাসে দুই হাজার টাকা লভ্যাংশ দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল।

পিরোজপুর জেলা সমবায় কর্মকর্তা মো. শরিফুল ইসলাম বলেন, সমবায় সমিতির আইন অনুযায়ী আমানতকারীকে দ্বিগুণ লভ্যাংশ দেওয়ার সুযোগ নেই। ছয় মাসের বেশি কেউ মেয়াদি আমানত রাখতে পারবেন না। যদি আমানত ছয় মাসের বেশি রাখতে চান, তাহলে তাঁকে আবার নবায়ন করতে হবে। এহসান গ্রুপ এসব নিয়মনীতি মানেনি।

পিরোজপুরের জেলা প্রশাসক আবু আলী মো. সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর আমরা এহসান গ্রুপের সম্পত্তির হিসাব নিয়েছি। তাতে দেখা গেছে, তাঁদের ব্যাংক হিসাবে কোনো টাকা নেই। কিছু সম্পত্তি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আছে। তবে সম্পত্তি বিক্রি করেও গ্রাহকের সব টাকা পরিশোধ করা সম্ভব হবে না।’

রাগীব আহসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ব্যবসায়িক অংশীদার হুমায়ুন কবিরের দেওয়া চেক ডিজঅনার মামলায় আমি কয়েক দিন হাজতবাস করলে তা সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। এরপর সমিতির ভবিষ্যৎ নিয়ে আতঙ্কিত সদস্যরা আমানত হারানোর আশঙ্কায় টাকা ফেরত চান। আমাদের হাতে টাকা না থাকায় ও করোনাকালে ব্যবসা খারাপ যাওয়ায় লভ্যাংশ ও আমানত ফেরত দিতে সমস্যা হচ্ছে। তবে কিছু আমানত ফেরত দেওয়া হয়েছে।’