আমন ধান নিয়ে বিপাকে কৃষক

দাকোপ, ডুমুরিয়া, তেরখাদা ও দিঘলিয়া উপজেলায় সরকারি লক্ষ্যমাত্রার এক ছটাকও ধান সংগ্রহ করা হয়নি।

আশীষ মণ্ডল এবার আট একর জমিতে আমন ধান চাষ করছিলেন। একরপ্রতি ফলন হয়েছে ৪৮ মণ। তবে সেই ধান বিক্রি করতে গিয়ে বিপাকে পড়তে হচ্ছে তাঁকে। একে তো ধানের দাম কম, তার ওপর ব্যবসায়ীরা নগদ টাকায় ধান কিনতে চাচ্ছেন না। শর্ত ও নানা ঝামেলায় খাদ্যগুদামে ধান দিতেও আগ্রহ নেই তাঁর।

আশীষের বাড়ি খুলনার দাকোপ উপজেলার সুতারখালী গ্রামে। বাজারে ধানের দাম কম থাকায় আশীষের মতো উপজেলার কয়েক হাজার কৃষক বিপদে পড়েছেন।

তরুণ এই কৃষক বলেন, সবকিছুর দাম বাড়ার কারণে ধান উৎপাদনের খরচ বেড়েছে, কিন্তু বাজারে ধানের দাম গত মৌসুমের তুলনায় কম। আবার অন্য বছর ধান খামারে ওঠানোর পরপরই ফড়িয়ারা নগদ টাকায় ধান কেনেন। এবার ফড়িয়া কম, কোনোভাবেই নগদ টাকা দিয়ে ধান নিতে চাচ্ছেন না তাঁরা। চরম খারাপ যোগাযোগব্যবস্থা আর নানা ঝামেলার কারণে খাদ্যগুদামেও এই এলাকার কৃষকেরা ধান দেন না। একই গ্রামের কৃষক তুষার কান্তি বলেন, এই অঞ্চলের অর্থনীতি আমননির্ভর। ধান বিক্রি করতে না পেরে চাষিরা খুবই বিপাকে আছেন।

খুলনা জেলায় সবচেয়ে বেশি আমন চাষ হয় দাকোপে। এই উপজেলায় সরকারি ন্যায্যমূল্যে এক ছটাকও আমন ধান সংগ্রহ করা হয়নি। এর বাইরে ডুমুরিয়া, তেরখাদা, দিঘলিয়া ও নগর এলাকায় কোনো ধান সংগ্রহ করা হয়নি। অন্য উপজেলায়ও নামমাত্র ধান সংগ্রহের ফলে খুলনা জেলা ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রায় অনেক পিছিয়ে আছে। খুলনায় গত বছরের ৭ নভেম্বর থেকে ধান সংগ্রহ ও চাল কেনার অভিযান শুরু হয়। ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই কার্যক্রম চলবে। গত আড়াই মাসে লক্ষ্যমাত্রার আট শতাংশ ধান সংগৃহীত হয়েছে। সংগ্রহ পরিস্থিতি ভয়াবহ খারাপ হওয়ার পেছনে ধানের বর্তমান বাজারদরকেই প্রধান কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সরকারিভাবে ধানের যে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে, স্থানীয় বাজারে প্রায় সেই দাম বা বেশি দামে ধান বেচাকেনা হচ্ছে। চলতি আমন মৌসুমে সরকার ধান সংগ্রহের জন্য প্রতি কেজির দাম ২৭ টাকা নির্ধারণ করেছে। এই হিসাবে ১ মণ ধানের দাম ১ হাজার ৮০ টাকা। খুলনা অঞ্চলের গ্রামীণ হাটবাজারে মৌসুমে শুরুর দিকে মণপ্রতি ৯৫০ থেকে ১ হাজার টাকায় ধান বিক্রি হলেও মাসখানেক ধরে ১ হাজার টাকার ওপরেই বিক্রি হচ্ছে। সরকারি গুদামে ধান বিক্রি করতে গেলে অনেক ঝক্কিঝামেলায় পড়তে হয়। গুদামসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ধানের আর্দ্রতা পরীক্ষা করে সরকারি নির্দেশনামতো হলে তারপর ধান কিনে থাকেন। এ ছাড়া পরিবহন খরচ আছে, যথেষ্ট সময়ও ব্যয় হয়।

কয়রা ও পাইকগাছা উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তা সুজিত কুমার মুখার্জি প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি দামের চেয়ে বাজারে ধানের দাম অনেক সময় বেশি থাকে। মাঠ থেকে বেশি আর্দ্রতাযুক্ত ধান কৃষকেরা বিক্রি করছেন প্রায় সরকারি দামেই। তাহলে কৃষক ঝামেলা করে গুদামে ধান দেবেন কেন? প্রচার চালিয়েও লাভ হবে না, লসে কৃষক ধান দেবেন না।

অনেক কৃষক এবার ধান বিক্রি করতে পারেননি। দাকোপের ধান ব্যবসায়ী বিকাশ রায় বলেন, ‘আমরা ধান কিনে মিলারদের দিই। মিলাররা আমাদের পাওনা টাকা বকেয়া রাখছেন। আমরাও নগদে কিনতে পারছি না। তবে এখনো এলাকায় প্রচুর ধান খামারে রয়ে গেছে।’

দাকোপের খেজুরিয়ার কৃষক উৎপল রপ্তান বলেন, ধানের দাম বাড়তে পারে, এমন ধারণায় কৃষক মৌসুমের প্রথম দিকে ধান ছাড়েননি। এখন দাম তো বাড়েইনি, ক্রেতাও তেমন মিলছে না। বেশির ভাগ চাষির খামারে ধান পড়ে আছে। আর খাদ্যগুদাম যে ধান নেয়, এই অঞ্চলের বেশির ভাগ মানুষ জানেন না। দুই-একজন জানলেও যোগাযোগব্যবস্থা আর নানা রকম ঝামেলায় কেউ সেখানে যান না।

জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের দপ্তর সূত্র জানায়, চলতি আমন সংগ্রহ মৌসুমে জেলার ১১টি গুদামে কৃষকের কাছ থেকে ৪ হাজার ৭৮৪ মেট্রিক টন ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এ ছাড়া জেলায় ৮ হাজার ৯৪৯ মেট্রিক টন সেদ্ধ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। চাল সংগ্রহের জন্য ১০৯টি মিলের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। সেদ্ধ চাল ৪০ টাকা কেজি দরে কেনা হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত জেলায় ৩৮৬ মেট্রিক টন ধান কেনা হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৮ শতাংশ। আর সেদ্ধ চাল কেনা হয়েছে ৪ হাজার ৮৩৪ মেট্রিক টন; যা লক্ষ্যমাত্রার ৫৪ শতাংশ।

খুলনা জেলা খাদ্যনিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ বাবুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সরকারিভাবে ধানের যে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে, স্থানীয় বাজারে তার চেয়ে বেশি দামে ধান বেচাকেনা হচ্ছে। এ কারণে খাদ্যগুদামে ধান সরবরাহ করতে কৃষকেরা আগ্রহী হচ্ছেন না। গুদামে ধান এনে যাতে কেউ ভোগান্তিতে না পড়েন, সে ব্যাপারে তাঁরা তৎপর আছেন।