‘আপনারাই প্রথম আইয়া চাউল-ডাইল দিলেন’

পটুয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা রাঙ্গাবালীতে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কাছে খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দেন প্রথম আলো বন্ধুসভার সদস্যরা।
শংকর দাস

ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে জলোচ্ছ্বাসের সময় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সখিনা বিবি (৬০) তাঁর স্বামী মোতালেব হোসেনের সঙ্গে ঘরেই ছিলেন। কিন্তু জলোচ্ছ্বাসে ঘরের ভিটার মাটি ধসে গেলে স্বামী সখিনাকে নিয়ে কোমর পানি ভেঙে বাঁধে আশ্রয় নিয়েছিলেন। আজ শনিবার দুপুরে সেই সখিনার হাতে তুলে দেওয়া হলো চাল, ডাল, সয়াবিন তেল, লবণ ও আলুর এক প্যাকেট খাদ্যসামগ্রী। দুর্যোগকালে খাদ্যসহায়তা পেয়ে খুব খুশি এই দম্পতি।

সখিনা বিবি বলেন, তাঁদের দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। তাঁর নিজের দুনিয়া অন্ধকার। স্বামী দিনমজুর হিসেবে কাজ করেন। কিন্তু এখন আর তিনি ভারী কাজ করতে পারেন না। তাই মানুষের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে বেঁচে আছেন তাঁরা। সখিনা বিবি বলেন, ‘বইন্যার দিন চিড়া ও চিনি দিছিল। বইন্যার পর আর কেউ খোঁজ নেয়নি। আপনারাই প্রথম আইয়া চাউল-ডাইল দিলেন। এহন কয়ডা দিন পেট ভইরা খাইতে পারুম।’

কাউখালী গ্রামের হালিমা বেগমও (৫০) প্রথম আলোর খাদ্যসামগ্রী প্যাকেট পেয়েছেন। হালিমার স্বামী নেই। দুই ছেলে থাকলেও তাঁরা অন্যত্র থাকেন। এখন বাঁধের ওপর আছেন তিনি। তিনিও জলোচ্ছ্বাসের পর প্রথম ত্রাণ পেয়েছেন বলে জানান। হালিমা বেগম বলেন, ‘এহনও ঘরডা ঠিক করতে পারি নাই। আবার পানি বাড়লে ঘর পইড়া যাইবে। কী করুম কিছু বুঝি না। এহন দুই বেলা খাওয়ার জন্য মাইনসের বাড়ি বাড়ি যাইতে হয়। এইর মধ্যে আপনারা তেরান দেছেন। এই তেরানে মোগো মতন গরিবের খুব উপকার হইবে।’

পটুয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা রাঙ্গাবালীর ছোটবাইশদিয়া ইউনিয়নের আগুনমুখা নদীর পাড়ের কোড়ালিয়া ও কাউখালী গ্রামের ৮০ জন বন্যাদুর্গত মানুষকে খাদ্যসহায়তা দিয়েছে প্রথম আলো ট্রাস্ট। আজ শনিবার দুপুরে কোড়ালিয়া গ্রামের আগুনমুখা নদীর পাড়ে ওই খাদ্যসামগ্রীর প্যাকেট বিতরণ করা হয়। বিতরণকাজে সার্বিক সহযোগিতা করে প্রথম আলো পটুয়াখালী বন্ধুসভা। খাদ্যসামগ্রীর মধ্যে ছিল চাল, মসুর ডাল, তেল, লবণ ও আলু।

ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে সৃষ্ট জোয়ারের জলোচ্ছ্বাসের আঘাতে রাঙ্গাবালীর আগুনমুখা নদীর তীরের কোড়ালিয়া এলাকার বাঁধ ভেঙে কোড়ালিয়া, কাটাখালীসহ আশপাশের গ্রামগুলো প্লাবিত হয়। পরবর্তী সময়ে জলোচ্ছ্বাসের পানি নেমে গেলেও এখনো অনেক এলাকায় পানি জমে রয়েছে। জলোচ্ছ্বাসের আঘাতে মানুষের বসতঘরে ভিটের মাটি পর্যন্ত ধসে গেছে।

এদিকে এই এলাকার বেশির ভাগই মাছ ধরে, নয়তো দিনমজুরি করে সংসার চালান। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের পর এখন তাঁদের বিধ্বস্ত ঘরটি মেরামত করতে পারেননি। তার ওপর সাগরে মাছ ধরা বন্ধ। এখন অনেকটা বেকার হয়ে পড়েছেন তাঁরা। এমন অবস্থায় এসব মানুষের হাতেই পৌঁছে দেওয়া হয়েছে খাদ্যসামগ্রী।

ছোটবাইশদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ওমর ফারুক বলেন, করোনার কারণে মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ে। এর মধ্যে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস। রাঙ্গাবালী এমনিতেই বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা। ঝড়ের সঙ্গে জলোচ্ছ্বাস এখানকার বাঁধের বাইরের মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিচ্ছিন্ন উপজেলায় হওয়ায় দীর্ঘ নদীপথ পাড়ি দিয়ে বেসরকারি উদ্যোগে তেমন কেউ সহায়তা নিয়ে আসছে না। তবে এই দুর্গম চরাঞ্চলের মানুষের পাশে এসে দাঁড়ানোর জন্য অবশ্যই প্রথম আলো ধন্যবাদ ও প্রশংসার দাবি রাখে।

গলাচিপায় বন্যাদুর্গত ৫০টি পরিবারকে খাদ্যসহায়তা

এর আগে আজ শনিবার সকালে পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার পানপট্টি ইউনিয়নের গুপ্তের হাওলা গ্রামের আগুনমুখা নদীর পাড়ে বাঁধের পাশে জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত ৫০টি পরিবারের হাতে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। ইয়াসের প্রভাবের জলোচ্ছ্বাসে বসতভিটের মাটিধসে এসব পরিবার ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ওই গ্রামের ঝুমুর বিবি (২৫) খাদ্যসামগ্রীর প্যাকেট হাতে পেয়ে খুশি। ঝুমুর বিবি বলেন, ‘মোগো বাড়িঘর সব তো জোয়ারের পানিতে লইয়া গেছে। জোয়ারের ঢেউ ঘরের ভিডার মাডিডাও ধুইয়া নিছে। তিনডা জোয়ারেই সব শেষ কইরা দিছে।’

ঝুমরি বিবির স্বামী আয়ুব মোল্লা নদীতে মাছ ধরেন। তিনি বলেন, ‘পাঁচবার নদী ভাইঙা নিছে ঘরবাড়ি। একটুখানি জমি আছিল, হেইয়াও নদীতে গেছে। নদীতে মাছ পড়ে না। করোনায় অন্য কামও পাই না। এই তেরান (খাদ্যসামগ্রী) দিয়া পোলাপাল লইয়া কয়ডা দিন ভালো থাহা যাইবে।’

পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার গুপ্তের হাওলা গ্রামে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কাছে খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দেন প্রথম আলো বন্ধুসভার সদস্যরা।

স্কুলের মাঠে ওই গ্রামের প্রতিবন্ধী মরিয়ম বেগম (২৫) খাদ্যসামগ্রীর প্যাকেট হাতে পেয়ে মুচকি হাসি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। মরিয়ম কথা বলতে পারেন না। কিন্তু মরিয়ম খাদ্যসামগ্রী প্যাকেটটি পেয়ে বুকে আগলে নিয়ে হাসতে হাসতে তাঁর বসতঘরে চলে যান।

প্রথম আলোর খাদ্যসামগ্রী বিতরণকালে উপস্থিত ছিলেন পানপট্টি ইউনিয়নের বীর মুক্তিযোদ্ধা ইলিয়াস মিয়া। তিনি বলেন, ‘দেশে দুর্যোগ এলেই প্রথম আলো নিজ উদ্যোগেই দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে। একটি পত্রিকা সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে যেভাবে মানুষের পাশে থাকছে, তা প্রশংসনীয়। প্রথম আলোর এমন উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই।’

প্রথম আলো পটুয়াখালী বন্ধুসভার সভাপতি জাহিদা আক্তার বলেন, ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর থেকেই প্রাকৃতিক দুর্যোগে উপকূলীয় পটুয়াখালী জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে প্রথম আলো ট্রাস্ট। এই উপকূলীয় জেলায় শুধু খাদ্যসহায়তাই নয়, শিক্ষাবিস্তারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অবকাঠামো দিয়ে সহায়তা। সুপেয় পানির জন্য গভীর নলকূপ স্থাপন, বসতঘর নির্মাণে সহায়তা। সেলাই মেশিনসহ গবাদিপশু বিতরণ করা হয়েছিল ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে। এরই ধারাবাহিকতায় গত বছর আম্পানের পরও পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী, গলাচিপা উপজেলাসহ জেলার ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে খাদ্যসহায়তা দেওয়া হয়েছিল। এবারও দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে প্রথম আলো।

এ সময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন প্রথম আলোর পটুয়াখালী প্রতিনিধি শংকর দাস, পটুয়াখালী বন্ধুসভার উপদেষ্টা আকাশ, সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রিফাত প্রমুখ।

ইয়াসে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সহযোগিতায় আপনিও এগিয়ে আসতে পারেন।
হিসাবের নাম: প্রথম আলো ট্রাস্ট/ত্রাণ তহবিল
হিসাব নম্বর: ২০৭ ২০০ ১১১৯৪
ঢাকা ব্যাংক লিমিটেড, কারওয়ান বাজার শাখা, ঢাকা