দিনাজপুরের হাকিমপুরে সাবেক মেয়রের বাড়িতে আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া শিক্ষার্থী আসাদুজ্জামান নূর ওরফে সূর্যের (১৭) মরদেহ ১ মাস ৪ দিন পর কবর থেকে উত্তোলন করা হয়েছে।
আদালতের নির্দেশে আজ মঙ্গলবার সকাল ১০টার দিকে হাকিমপুর পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের বড় ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের একটি কবরস্থান থেকে মরদেহটি উত্তোলন করা হয়। এ সময় উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট লায়লা ইয়াসমিন ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন।
বেলা ১১টার দিকে মরদেহটি কবর থেকে তোলার পর প্রাথমিক সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে দিনাজপুর এম আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগে পাঠায় পুলিশ। এ সময় হাকিমপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দুলাল হোসেন, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আরিফুল ইসলামসহ অন্যান্য পুলিশ সদস্য উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে গত ২৫ আগস্ট মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দিনাজপুর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আমলি আদালতে মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য আসাদুজ্জামানের মরদেহ কবর থেকে তুলে ময়নাতদন্তের আবেদন করেন। আদালতের বিচারক সোহাগ আলীর হাকিমপুর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) লায়লা ইয়াসমিনের উপস্থিতিতে মরদেহ উত্তোলন করে প্রাথমিক সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি ও ময়নাতদন্তের ব্যবস্থা নিতে পুলিশকে নির্দেশ দেন।
নিহত আসাদুজ্জামান নূর বড় ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের মজনু মিয়ার ছেলে। সে হাকিমপুর উপজেলার জালালপুর উচ্চবিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। গত ৫ আগস্ট রাত সাড়ে ১১টার দিকে হাকিমপুর পৌরশহরের হিলি বাজারে সাবেক পৌর মেয়র জামিল হোসেনের আগুনে পোড়া বাড়ি থেকে আসাদুজ্জামানসহ দুজনের মরদেহ উদ্ধার করেছিলেন ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। পর দিন সকালে বিনা ময়নাদতন্তে আসাদুজ্জামানের মরদেহ গ্রামের বাড়িতে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা তখন জানিয়েছিলেন, ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর বিক্ষুব্ধ জনতা হাকিমপুর পৌর মেয়র জামিল হোসেনের বাড়িতে হামলা করে আগুন লাগিয়ে দেয়। স্থানীয় লোকজনের ধারণা, আন্দোলনকারীরা যখন ওই বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়, তখন হয়তো আসাদুজ্জামানসহ ওই দুজন বাড়িতে আটকা পড়েছিল। আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে বের হতে না পেরে সেখানে তাদের মৃত্যু হয়।
তবে এ ঘটনায় গত ১৯ আগস্ট সকালে আসাদুজ্জামানের বড় ভাই মো. সুজন বাদী হয়ে হাকিমপুর থানায় যে হত্যা মামলা করেন, তাতে ভিন্ন অভিযোগ আনা হয়। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ৪ আগস্ট বেলা আড়াইটার দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অংশ হিসেবে হাকিমপুর পৌর শহরে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় সাবেক সংসদ সদস্য শিবলী সাদিকের নির্দেশে হাকিমপুর উপজেলা, পৌর ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা হিলি রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মের নিচে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেন। এ সময় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা আন্দোলনে অংশ নেওয়া আসাদুজ্জামান নূর, নাঈম হোসেন, নাফিজ, মোস্তাকিম মেহেদী, মহিদুল ও বাবু আহম্মেদকে মারধর করতে করতে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যান। পরে আসাদুজ্জামান ও নাঈমকে পৌর মেয়র জামিল হোসেনের বাড়িতে টর্চার সেলে নিয়ে যান আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। সেখানে তাঁদের শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের ফলে সেখানে সূর্য ও নাঈমের মৃত্যু হয়। পরে আসামিরা এ দুজনের লাশ গুম করার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লে গভীর রাতে নাফিজ, মোস্তাকিম মেহেদী, মহিদুল ও বাবু আহম্মেদ কৌশলে পৌর মেয়রের বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। পরদিন বেলা সাড়ে তিনটার দিকে নিহত এ দুজনের মরদেহ পুড়িয়ে ফেলে হত্যার ঘটনাকে ভিন্ন খাতে নিতে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বাড়িতে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন। পরে রাতে ফায়ার সার্ভিসের একটি দল ঘটনাস্থলে গিয়ে পৌর মেয়র জামিল হোসেনের বাড়ি থেকে আসাদুজ্জামান ও নাঈমের মরদেহ উদ্ধার করে।
এই মামলায় আসামি হিসেবে দিনাজপুর-৬ (হাকিমপুর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শিবলী সাদিক, সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হারুন উর রশিদ, পৌর মেয়র জামিল হোসেনসহ ২৩ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া আরও ৯০ থেকে ১০০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই আরিফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য নিহত আসাদুজ্জামান নূরের মরদেহ কবর থেকে উত্তোলন করে ময়নাতদন্তের জন্য দিনাজপুর আদালতে আবেদন করা হয়েছিল। আজ সকাল ১০টায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে তাঁর মরদেহ কবর থেকে উত্তোলন করা হয়। বেলা ১১টার দিকে মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য দিনাজপুর এম আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগে পাঠানো হয়েছে। মামলার তদন্ত কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।