ময়মনসিংহের নান্দাইলে একটি আতশবাজি কারখানায় বিকট বিস্ফোরণে দুই নারী নিহত হয়েছেন। আধা পাকা যে বাড়িতে কারখানাটি ছিল, সেটি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। উড়ে গেছে বাড়িটির টিনের চালা ও দরজা-জানালা। লাশ দুটি দেখে চেনার উপায় নেই। ছিন্নভিন্ন হয়ে দেহের নানা অংশ ছড়িয়ে–ছিটিয়ে পড়েছে।
উপজেলার চণ্ডীপাশা ইউনিয়নের দক্ষিণ বাঁশহাটি গ্রামে আজ বুধবার সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। নিহত দুজন হলেন আবুল হোসেনের স্ত্রী নাছিমা খাতুন (৩০) ও আবদুল গণির স্ত্রী আপিলা খাতুন (৫০)। তাঁরা কারখানাটির শ্রমিক ছিলেন। খবর পেয়ে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যসহ ও শত শত মানুষ ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন। স্থানীয় ও জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। তদন্ত করার জন্য বিস্ফোরক অধিদপ্তরের একটি দল ঘটনাস্থলে পৌঁছেছে।
বিস্ফোরণস্থলটি নান্দাইল সদর থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে। সরেজমিনে দেখা যায়, বিস্ফোরণে গোটা বাড়িটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। লোহার দরজা ও জানালাগুলো উড়ে গিয়ে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে। গাছের ডালে লেগে রয়েছে মানবদেহের বিভিন্ন অংশ। একটি মরদেহ চেনার কিছুটা উপায় থাকলেও অপরটি চেনার কোনো উপায় নেই। ঘরের বিভিন্ন কক্ষে হাজারো আতশবাজির খোসা পড়ে রয়েছে। শত শত মানুষ চারপাশে ভিড় করে এ দৃশ্য দেখছিলেন।
বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়েছিলেন নান্দাইল মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মিজানুর রহমান আকন্দ। স্থানীয় ব্যক্তিদের বরাতে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, স্থানীয় লোকজন তাঁকে জানিয়েছে ঘটনার সময় নাকি বজ্রপাত ঘটেছিল। ঠিক একই সময় বাড়ির বিভিন্ন কক্ষে লাগাতার বিস্ফোরণ ঘটতে থাকে। বিস্ফোরণের ধাক্কায় পুরো বাড়ির ইট–কাঠ ও দরজা-জানালা উড়ে গেছে।
নান্দাইল ফায়ার সার্ভিসের সদস্য মশিউর রহমান বলেন, খবর পেয়ে তাঁরা দলবল নিয়ে এ বাড়িতে এসে দেয়াল ও ইটের স্তূপের নিচে চাপা পড়া দুজন নারীর মরদেহ উদ্ধার করেছেন। ধ্বংসস্তূপের নিচে আরও মরদেহ রয়েছে কি না, তা বোঝা যাচ্ছে না।
বিস্ফোরণের ধাক্কায় বাড়ির পাকা মেঝে দেবে গেছে। প্রতিটি কক্ষের ঘরের সিলিং ঝুলে পড়েছে। আসবাবপত্রের কাচ চুর্ণ হয়ে পড়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ফায়ার সার্ভিস দলের এক সদস্য বলেন, বজ্রপাতের ঘটনা বলে একটি চক্র যে প্রচারণা চালাচ্ছে তা ক্ষয়ক্ষতির নমুনার সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
উঠানের এক কোণে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন পাশের বাড়ির বাসিন্দা আবদুল গণি (৬৫)। তিনি বলেন, বিস্ফোরণে তাঁর স্ত্রী আপিলা খাতুন নিহত হয়েছেন। তাঁর স্ত্রী এই কারখানায় সাত বছর ধরে আতশবাজি তৈরির কাজ করতেন। এই কাজের জন্য তাঁর স্ত্রী সপ্তাহে তিন হাজার টাকা পেতেন। গ্রামের অনেকেই এখানে কাজ করেন। সকাল ছয়টার দিকে প্রচণ্ড শব্দে তাঁর ঘুম ভেঙে যায়। তিনি দ্রুত এখানে এসে দেখতে পান বাড়িটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
আবদুল গণি আরও বলেন, বিস্ফোরণের পর কারখানা ও বাড়ির মালিক বোরহান উদ্দিনের কাছে তাঁর স্ত্রীর আপিলার অবস্থা জানতে চান। তখন বোরহান তাঁকে জানান, আপিলা চলে গেছেন। অথচ বোরহানের চোখের সামনেই তাঁর স্ত্রীর লাশ চাপা পড়ে ছিল। পরে চারপাশে ছড়ানো ধ্বংসস্তূপের নিচে তাঁর স্ত্রীকে পড়ে থাকতে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন। ঘটনার পরপরই বোরহান উদ্দিন স্থানীয় প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গা ঢাকা দিয়েছেন।
দক্ষিণ বাঁশহাটি গ্রামের বাসিন্দা সিএনজিচালক সাইদুল ইসলাম বলেন, তিনি ঘটনার সময় এক কিলোমিটার দূরে নান্দাইল চৌরাস্তা এলাকায় যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এ সময় তাঁর গ্রামের দিক থেকে বিকট শব্দ শুনতে পান। পরে তিনি বাড়িতে ফোন করে পরিবারের খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারেন এ বিস্ফোরণের কথা। দ্রুত গ্রামে ফিরে এসে নারকীয় এ দৃশ্য দেখতে পান।
স্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বোরহান উদ্দিন কয়েক বছর আগে চৌরাস্তা এলাকায় ডালের বড়া বিক্রি করতেন। বাড়িতে আতশবাজি কারখানা স্থাপনের পর ডালের বড়া বিক্রির ব্যবসা ছেড়ে দেন। পরে তাঁর বাড়িঘরে চাকচিক্য দেখা দেয়। বাড়িতে দৃশ্যমান পরিবর্তন আসতে শুরু করে। গ্রামবাসীর ধারণা, স্থানীয় প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করে বাড়িতে অবৈধভাবে আতশবাজির কারখানা স্থাপন করেন। ওই কারখানায় প্রায় ৫০ জনের মতো শ্রমিক কাজ করতেন।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (গৌরীপুর সার্কেল) মোস্তাফিজুর রহমান ঘটনাস্থল থেকে মুঠোফোনে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের বিবরণ দিচ্ছিলেন। তখন তাঁকে বলতে শোনা যায় প্রচুর পরিমাণ বারুদ একসঙ্গে বিস্ফোরিত হওয়ায় এ ধরনের বিধ্বংসী ঘটনা ঘটেছে।
নান্দাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ আবুল মনসুর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বারুদ বিস্ফোরণের ফলে এ ঘটনা ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিস্ফোরক অধিদপ্তরের লোকজন ঘটনাস্থলে গেছেন। তাঁরা তদন্ত করার পর প্রকৃত ঘটনা জানা যাবে।