বিশ্বের দীর্ঘতম সৈকত কক্সবাজারের প্যাঁচার দ্বীপের ভেজা বালুচরে হাজার হাজার লাল কাঁকড়ার রাজত্ব-দৌড়ঝাঁপ চলছে। এক একটি কাঁকড়ার ওজন ৩০০-৫০০ গ্রাম। দৃশ্যটি গতকাল রোববার বিকেল পাঁচটার। বালুচরে দাঁড়িয়ে কাঁকড়ার অবাধ বিচরণের দৃশ্য দেখা গেল। সৈকত–সংশ্লিষ্টরা জানালেন, করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে কক্সবাজার সৈকত পর্যটকদের জন্য বন্ধ থাকায় কাঁকড়াগুলোর এমন অবাধ বিচরণ সম্ভব হয়েছে।
তবে ব্যাপক পরিসরে কাঁকড়ার অবাধ বিচরণের দৃশ্য আজ থেকে হয়তো সেভাবে দেখা আর সম্ভব হবে না। আজ সোমবার ১৭ আগস্ট থেকে পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত হচ্ছে কক্সবাজার সৈকত। হোটেল, মোটেল, কটেজ, গেস্টহাউস, রেস্তোরাঁ পর্যটক বরণে প্রস্তুত। খুলে দেওয়া হয়েছে বিনোদন কেন্দ্রগুলোও। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসবেন লাখো মানুষ। সমুদ্রসৈকতের লোনা জলে শরীর ভিজিয়ে লোকজন বালুচরে দেবেন দৌড়ঝাঁপ। ঘোড়ার পিঠে চড়ে কিংবা বিচ বাইকে উঠে ছুটবেন বালুচরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলবে কোলাহল-হইচই। মানুষ ও ঘোড়ার পায়ে পিষ্ট হয়ে বা বিচ বাইকের চাকায় চাপা পড়ে বিলীন হবে কাঁকড়ার জীবন, ধংস হবে বালুর বাসা। আবারও সংকুচিত হয়ে পড়বে লাল কাঁকড়ার রাজত্ব। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে লাল কাঁকড়াগুলো রক্ষার কোনো উদ্যোগও নেই। তাহলে এই লাল কাঁকড়ার কী হবে?
বালুচরে কাঁকড়ার ‘যম’ মানুষ
বালুচরে খানিক্ষণ দাঁড়ালে বোঝা যায় কাঁকড়ার রহস্যময় জীবন। সেটা কী রকম? সৈকতের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত যত দূর চোখ যায়, দৃষ্টিসীমায় দেখতে পাবেন নানা নকশার আলপনায় আঁকা বিশাল বালুচর। ভেজা বালু দিয়ে ছোট ছোট বল বানিয়ে কাঁকড়ার দল সাজিয়েছে সেই আলপনা। আলপনার ভেতরে-বাইরে গর্ত খুঁড়ে তৈরি করেছে কত শত বাসা। প্রজনন ও নিজেদের লুকিয়ে রাখার জন্য কাঁকড়া গর্ত খনন করে। গর্ত বা বাসার গভীরতা সর্বোচ্চ এক ফুট। জোয়ারের পানিতে অসংখ্য বাসা বিলীন হয়, ভেঙেও যায়। তাতে সমস্যা হয় না কাঁকড়ার। কারণ সামনে যার গর্ত পড়বে, বাসাও তার হয়ে যায়। কার বাসায় কে ঢুকে পড়ছে, হিসাব নেই।
তবে কাঁকড়ার ‘যম’ হচ্ছে মানুষ। পায়ের নিচে চাপা পড়লে বাসা ভেঙে যায়, সঙ্গে গর্তের ভেতরে থাকা কাঁকড়ারও মৃত্যু ঘটে মাটিচাপায়।
করোনাকালের দীর্ঘ পাঁচ মাস সৈকতে কোনো লোকসমাগম ছিল না, ছিল না মানুষের হইচই। পুরো সৈকত হয়ে পড়ে ফাঁকা । আর এ সময়টুকুতে বিশ্বের দীর্ঘতম সৈকতে রাজত্ব গেড়েছিল লাল কাঁকড়ার দল।
প্যাঁচার দ্বীপ এলাকার একজন জেলে সলিম উল্লাহ (৪৫) বলেন, ভোর, সকাল ও বিকেল থেকে সন্ধ্যার সময়টায় সৈকতে লাল কাঁকড়ার বিচরণ দেখা যায় বেশি। কারণ এ সময় মানুষের কোলাহল কম থাকে। অন্য সময় কাঁকড়া প্রাণ বাঁচাতে গর্তের ভেতরে লুকিয়ে থাকে। কিন্তু মানুষের পায়ের চাপায় গর্তের ভেতরে লুকিয়ে থাকা কাঁকড়ার মৃত্যু হয় বেশি।
লাল কাঁকড়ার মতো সদা ব্যস্ত এবং চঞ্চল প্রাণী দ্বিতীয়টি নেই। আপনি বালুচর দিয়ে হাঁটছেন, দেখবেন কিছু কাঁকড়া গর্তে ঢুকে পড়ছে, কেউ গর্ত থেকে বেরিয়ে বালুচরে এলোমেলোভাবে দৌড়াচ্ছে। কেউ আবার গর্তের মুখে দাঁড়িয়ে মানুষের গতিবিধি লক্ষ করছে। আপনি যতই কাছে যাবেন, কাঁকড়াগুলো দল বেঁধে তত বেশি ছোটাছুটি করছে। তবে ইচ্ছা করলে যে কেউ কাঁকড়া ধরতে পারে। সে ক্ষেত্রে গর্ত ভেঙে মাটির নিচ থেকে কাঁকড়া ধরে আনতে হবে। তবে সাবধান, সুযোগ পেলে কাঁকড়া হাতে কামড় বসিয়ে দিতে পারে। শক্ত খোলসবিশিষ্ট অমেরুদণ্ডী প্রাণী লাল কাঁকড়ার পা আছে আটটি। কিন্তু চলাচল বা দৌড়ঝাঁপ চলে ছয়টি পা দিয়ে। সামনের পা দুটো অপেক্ষাকৃত মোটা এবং এই পা দুটো অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে ওরা। ধরতে চাইলে এই পা দুটো দিয়েই কামড় বসিয়ে দেয়। পুরো লাল দেহের কাঁকড়ার উপরিভাগে খাড়া চোখ দুটোই কেবল সাদা।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট কক্সবাজারের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এহসানুল করিম বলেন, জোয়ারের পানিতে ভেসে আসা মরা মাছ, শামুক-ঝিনুক, মাছের পোনা ও ময়লা–আবর্জনা কাঁকড়ার পছন্দের খাবার। ১৬ প্রজাতির কাঁকড়ার মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় লাল কাঁকড়া। স্থানীয় ভাষায় এটিকে বলে রাজকাঁকড়া। লাল কাঁকড়া সৈকতের ময়লা–আবর্জনা সাফ করে সৈকত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখে।
কাঁকড়া রক্ষায় উদ্যোগ নেই
পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, শহরের ডায়াবেটিক হাসপাতাল পয়েন্ট থেকে দক্ষিণ দিকে কলাতলী পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার সৈকতে পর্যটকসহ মানুষের সমাগম থাকে সব সময়। উখিয়া, ইনানী ও টেকনাফ সৈকতের আরও ছয় কিলোমিটারেও থাকে লোকসমাগম। এই ১১ কিলোমিটারের বাইরে অরক্ষিত আরও ১০৯ কিলোমিটার সৈকতকে কাঁকড়া ও অন্যান্য প্রাণীর জন্য ‘সংরক্ষিত অঞ্চল’ ঘোষণা করা যায়। তখন বিশাল সৈকতে কাঁকড়া, কচ্ছপসহ প্রাণীর নিরাপদ অঞ্চল গড়ে তোলা সম্ভব। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু পরিকল্পনা কার্যকর করা কঠিন হবে। কারণ সৈকতের পরিবেশ-জীববৈচিত্র্য ধংস করেই পর্যটনের প্রসার ঘটাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।
পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজারের সহকারী পরিচালক শেখ মো. নাজমুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে গত ১৮ মার্চ সৈকতে পর্যটকের সমাগম নিষিদ্ধ করে প্রশাসন। করোনাকালের দীর্ঘ পাঁচ মাসে সৈকতের রূপ পাল্টেছে। গভীর সাগর থেকে দল বেঁধে ডলফিন চলে এসেছে কাছাকাছি এলাকায়। ডলফিনের ডুব–সাঁতারে মুগ্ধ হয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। ডিম পাড়তে আসছে মা কচ্ছপ। বিশাল বালুচরে লাল কাঁকড়ার বিস্তার ঘটেছে অনেক।
তিনি বলেন, আজ থেকে সৈকত খুলে যাচ্ছে। আগের মতো লোকসমাগম বেড়ে গেলে সৈকতের নির্মল এই পরিবেশ ধরে রাখা কঠিন হবে। তখন লাল কাঁকড়াও শেষ হয়ে যাবে।
কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদ সভাপতি দীপক শর্মা বলেন, সৈকতের লাবণী পয়েন্ট থেকে কলাতলী পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার সৈকতে ৩০ বছর আগেও লাল কাঁকড়ার বিচরণ ছিল। মানুষের কোলাহল, মানুষের পায়ের নিচে পড়ে, বিচ বাইক-ঘোড়ার পায়ের চাপায় বিলুপ্ত হয় কাঁকড়ার রাজ্য। তবে করোনাকালের টানা পাঁচ মাস সৈকতের এই পাঁচ কিলোমিটারে লোকসমাগম বন্ধ থাকায় লাল কাঁকড়াসহ নানা প্রাণীর বিচরণ আবার শুরু হয়। কিন্তু তা এখন আর ধরে রাখা সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, আজ থেকে সৈকতে হাজার হাজার মানুষের কোলাহল বাড়বে। এক হাজার মানুষের ধারণক্ষমতার এতটুকু সৈকতে যদি এক লাখ মানুষের রাত–দিন দৌড়ঝাঁপ চলে, তাহলে কাঁকড়ার প্রাণ বাঁচে কী করে? এভাবে জীববৈচিত্র্য রক্ষা সম্ভব নয়।