রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মেলেনি নওগাঁর রানীনগর উপজেলার মিরাট ইউনিয়নের আতাইকুলা পালপাড়া গ্রামের ১০ ‘বীরাঙ্গনা’ নারীর। এর মধ্যে দুজন মারা গেছেন। অন্য আটজন সরকারঘোষিত কোনো সুযোগ-সুবিধাও পাচ্ছেন না।
ভুক্তভোগী ও স্বজনদের দাবি, পালপাড়া গ্রামের রেণু বালা, মায়া সূত্রধর, রাশমুনি সূত্রধর, কালীদাসী পাল, সুষমা পাল, সন্ধ্যা পাল, গীতা রানী পাল, ক্ষান্ত বালা পালসহ ১০ জন নারী ১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে বাণী রানী পাল ও কান্তা রানী পাল মারা গেছেন। একাত্তরের সেই দুর্বিষহ যন্ত্রণা, সামাজিক বঞ্চনার পাশাপাশি অভাব-অনটন আর অসুস্থতার মধ্যেই চলছে তাঁদের জীবনসংগ্রাম। ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বীরাঙ্গনা নারীদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। কিন্তু সেই তালিকায় রানীনগরের এই ১০ জন বীরাঙ্গনার নাম ওঠেনি। তাঁরা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল। আতাইকুলার পালপাড়া গ্রামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর স্থানীয় দোসর রাজাকার, আলবদর সদস্যদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত নির্যাতন চালানো হয়। এই সময় সংখ্যালঘু হিন্দু পরিবারের কিশোর, যুবক, মাঝবয়সী ও নানা বয়সের নারীদের ধরে গ্রামের সুরেস্বর পালের বাড়িতে জড়ো করা হয়। সেখানে গোবিন্দ চরণ পাল, সুরেশ্বর পাল, বিক্ষয় সূত্রধর, নিবারণ পালসহ ৫২ জনকে হত্যা করা হয়। সন্তান ও স্বামীদের বাঁচাতে নারীরা এগিয়ে গেলে তাঁদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়।
সেদিনের সেই বর্বরতার সাক্ষী কালীদাসী পাল (৭৮) বলেন, ওই দিন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সদস্যরা স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় তাঁদের বাড়ি থেকে তাঁর স্বামীকে টেনেহিঁচড়ে রাইফেল দিয়ে মারতে মারতে যোগেন্দ্রনাথের বারান্দায় ফেলে রাখেন। তিনি স্বামীর প্রাণভিক্ষা চাইতে যান। তাঁর চোখের সামনে তাঁর স্বামীসহ ৫২ জনকে হত্যা করা হয়। এরপর তিনি পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন। এ সময় আরও অনেক নারীর ওপর বীভৎস পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়। তিনি বলেন, ‘নির্যাতনের শিকার হয়ে যাঁরা বেঁচে রয়েছেন, তাঁদের খেয়ে না-খেয়ে দিন চলছে। আমিও পেটের তাগিদে কখনো ধান কুড়িয়ে, বয়লারের চাতালে কাজ করে, কিংবা অন্যের জমিতে শ্রমিকের কাজ করে দুই মুঠো ডাল-ভাত খেয়ে কোনোমতো বেঁচে আছি। কেউ আমাদের খোঁজ নেয় না, সবাই শুধু আশ্বাস দিয়ে যান।’
আতাইকুলা গ্রামের পালপাড়ার গৌতম পাল বলেন, ‘দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কত বছর চলে গেল। কিন্তু এই গ্রামের শহীদ ও বীরাঙ্গনাদের নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় ওঠেনি।’
উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এই নারীদের পাশবিক নির্যাতনের শিকার হওয়ার তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। এই গ্রামের বীরাঙ্গনা ও শহীদ পরিবারের সদস্যরা জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে আবেদন করার পরিপ্রেক্ষিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) প্রধান করে একটি কমিটি সরেজমিনে তদন্ত করেছে। আমি আশা রাখি, তদন্ত প্রতিবেদন কাউন্সিলে জমা হলেই তাঁদের নাম গেজেটভুক্ত করা হবে এবং তাঁরা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিসহ সব সুযোগ-সুবিধা পাবেন।’
ইউএনও আল মামুন বলেন, ‘ইতিমধ্যে আমাদের তদন্ত প্রতিবেদন মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল বরাবর পাঠিয়েছি। এই গ্রামের বীরাঙ্গনাদের দ্রুত রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিসহ যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা প্রদানের জন্য মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করব।’