বেশি দাম পাওয়ার আশায় আগাম আলু চাষ করেছেন কৃষকেরা। প্রথমে ভালো দামও পেয়েছিলেন। কিন্তু দাম কমে যাওয়ায় এখন তাঁদের লোকসান হচ্ছে।
বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার উথলি গ্রামের তরিকুল ইসলাম (৩৫) গত মৌসুমে দুই বিঘা জমিতে আগাম আলু চাষ করেছিলেন। বাজার চাঙা থাকায় আলু বিক্রি করে খরচ বাদে তাঁর অর্ধলক্ষাধিক টাকা লাভ হয়েছিল। কিন্তু এবার মৌসুমের শুরু থেকেই আলুর বাজার মন্দা। ৩ বিঘা জমিতে আগাম আলু চাষ করে ২০ হাজার টাকা লোকসান হয় তাঁর।
মৌসুমের শুরু থেকেই বাজার মন্দার কারণে আগাম আলু চাষ করে তরিকুলের মতো বিপদে পড়েছেন বগুড়া, নীলফামারী ও মুন্সিগঞ্জের হাজারো কৃষক। এই আলু চাষ করে এসব এলাকার অনেক কৃষকের কয়েক লাখ টাকা পর্যন্ত লোকসান হয়েছে।
শিবগঞ্জ উপজেলার কয়েক কৃষক বলেন, বাজারে চাহিদা থাকায় খেত থেকেই পাইকার ও ব্যবসায়ীরা আলু কিনে নিয়ে যেতেন। এবার খেত থেকে আলু তুলে হাটে নিয়েও কাঙ্ক্ষিত দাম মিলছে না। হাটে-মাঠে আলুর বাজার মন্দার কারণে উৎপাদন খরচ তুলতে না পেরে হতাশ কৃষকেরা। বাজার মন্দার সঙ্গে মাঘ মাসের বৃষ্টিতে আলুখেত ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায়, ফলন বিপর্যয়ের শঙ্কায় ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ অবস্থা কৃষকের।
বগুড়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এবার জেলায় ৫৭ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে দেশি পাকরি, গ্র্যানুলা, ডায়মন্ড, কার্ডিনালসহ নানা জাতের আলু চাষ হয়েছে। এর মধ্যে আগাম আলু চাষ হয়েছে প্রায় ২০ হাজার হেক্টর জমিতে।
বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার মহাস্থান সবজির মোকাম ছাড়াও রায়নগর, অনন্তবালা, ঘাগুরদুয়ার, সেকেন্দ্রাবাদ, টেপাগাড়িসহ বিভিন্ন এলাকার আলুচাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিবছরের মতো ভালো দাম পাওয়ার আশায় এবারও তাঁরা খেতে দেশি পাকরি, গ্র্যানুলা, কার্ডিনালসহ নানা জাতের আলু চাষ করেছেন। মাস দেড়েক আগে থেকে খেতের আলু তুলে হাটে বিক্রি করছেন তাঁরা। কিন্তু এবার মৌসুমের শুরু থেকেই বাজার মন্দা। এতে আগাম আলু চাষ করে লোকসানে পড়েছেন তাঁরা।
শিবগঞ্জ উপজেলার টেপাগাড়ি গ্রামের কৃষক সাহের আলী বলেন, ‘এক কেজি আগাম দেশি আলু চাষে খরচ পড়ছে ১১ টেকা। ৪০০ টেকা মণ দরে আলু বিক্রি করে খরচ উটিচ্চে না (উঠছে না)।’
শনিবার বেলা ১১টার দিকে মহাস্থান হাটে গিয়ে কৃষক ও আড়তদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এক মাস আগেও প্রতি মণ দেশি লাল পাকরি আলু ৮০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার এই আলু বিক্রি হয়েছে ৪০০ টাকায়। শনিবার ভালো মানের আলু বিক্রি হয় ৪৫০ টাকায়। এদিন মহাস্থান পাইকারি মোকামে প্রতি মণ কার্ডিনাল আলু ৩৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এক মাস আগে এই হাটে প্রতি মণ কার্ডিনাল আলু বিক্রি হয় ৫০০ টাকায়। শনিবার মহাস্থান পাইকারি মোকামে প্রতি মণ সাদা গ্র্যানুলা আলু বিক্রি হয়েছে ৩২০ থেকে ৩৫০ টাকায়। এক মাস আগে এই মোকামে প্রতি মণ গ্র্যানুলা জাতের আলু বিক্রি হয় ৪০০ টাকায়।
কৃষকেরা জানান, এক বিঘা জমিতে আগাম আলু চাষে উৎপাদন খরচ গড়ে ৩০ হাজার টাকা। এক বিঘা জমিতে এবার আলু উৎপাদন হয়েছে গড়ে ৬০ থেকে ৭০ মণ। এবার দেশি আগাম আলু ২০০ থেকে ৩০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হয়েছে। এই হিসাবে প্রতিবিঘায় কৃষকের গড়ে ৯ হাজার টাকা লোকসান হচ্ছে।
বগুড়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক মো. এনামুল হক প্রথম আলোকে বলেন, এবার যে পরিমাণ জমিতে আগাম আলু চাষ হয়েছে, তাঁর মধ্যে ২৬ শতাংশ জমি থেকে আলু তুলেছেন কৃষকেরা। অবশিষ্ট জমির আলু খেতেই রয়েছে। মাঘের বৃষ্টিতে খেতে জমে থাকা পানিতে আলু ও সবজির ফলনবিপর্যয় ঘটবে। বাজারে সবজির সরবরাহ কমলে আলুর বাজার চাঙা হবে।
আগাম আলুর বাজার মন্দা থাকায় বগুড়ার মতো নীলফামারীর চাষিরাও দুশ্চিন্তায় আছেন। এ কারণে অনেকে জমি থেকে আলু তুলতে চাচ্ছেন না তাঁরা। কৃষকরা বলছেন, বিঘাপ্রতি আলু উৎপাদনে খরচ হয় ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকা, বর্তমান বাজারদর ৫ থেকে সাড়ে ৫ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি করলে বিঘাপ্রতি ১২ হাজার টাকা আসে। সেই হিসাবে প্রতি বিঘায় কৃষককে প্রায় তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে।
নীলফামারী সদর উপজেলার রামনগর ইউনিয়নের মাঝাপাড়া গ্রামের আলুচাষি মো. ইব্রাহিম আলী বলেন,‘দেড় বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছি। এখন বাজারে আলুর দাম কম। প্রতি বিঘায় খরচ হয়েছে প্রায় ১৫ হাজার টাকা। এখন বিক্রি করছি পাঁচ টাকা কেজি দরে। প্রতি বিঘায় সর্বোচ্চ ৫০ মণ পর্যন্ত আলু হতে পারে। ৫০ মণ আলু বিক্রি হবে ১০ হাজার টাকায়। তাহলে বিঘায় লোকসান হবে পাঁচ হাজার টাকা।
মাঝাপাড়া গ্রামের আরেক কৃষক মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমি চার বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছি। এর মধ্যে আগাম আলু করেছি দুই বিঘায়। ওই দুই বিঘার আলুর দাম পেয়েছি। তখন অল্প কিছু লাভ হয়েছে। বাকি দুই বিঘার মধ্যে আরও এক বিঘা জমির আলু তুলেছি। কিন্তু ক্রেতার অভাবে বিক্রি করতে পারছি না। এই দুই বিঘা জমিতে আমার প্রায় ১০ হাজার টাকা লোকসান হবে।
আলু ব্যবসায়ী লেবু মিয়া বলেন, ‘আমরা জমিতে আলু কিনছি পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ টাকা কেজি দরে। গতকাল মঙ্গলবার ওই আলু সাড়ে পাঁচ টাকা কেজি দরে কিনেছি। আজকের বাজারে পাঁচ টাকার বেশি দেওয়া যায় না।’ তিনি জমি থেকে আলু কিনে ট্রাকযোগে ঢাকা, খুলনা, রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠান বলে জানান। লেবু মিয়া বলেন, ‘এই আলু ছয় থেকে সাড়ে ছয় টাকা কেজি দরে বিক্রি হবে। তাতে খরচ বাদে আমার কোনো লাভ থাকবে না।’
জেলা কৃষি বিভাগ সূত্র মতে এ বছর জেলায় আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ২২ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে। লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে আবাদ হয়েছে ২২ হাজার ৩১০ হেক্টরে। আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৪৯ হাজার ৭৯১ মেট্রিক টন।
গত বছর ২২ হাজার ২৭০ হেক্টর জমিতে আলু উৎপাদন হয়েছিল ৪ লাখ ৪৮ হাজার ১৫০ মেট্রিক টন।
এই এলাকায় সাগিতা, সেভেন, কারেজ, রোমানা, ডায়মন্ড, গ্র্যানুলা, বিরি আলু ৩৭, ৫৭–সহ বিভিন্ন জাতের আলুর আবাদ হয়ে থাকে। এর মধ্যে সেভেন, গ্র্যানুলা, সাগিতা, কারেজ লাল পাকরি জাতের আলু বেশি আবাদ হয়।
জেলা শহরের পাইকারি আলু ব্যবসায়ী মো. রবিউল ইসলাম (২৫) বলেন, ‘আলুর এখন ভরমৌসুম। সে কারণে দাম কম। আমরা আলুর প্রকারভেদে সাড়ে পাঁচ থেকে সাড়ে ছয় টাকা কেজি দরে কিনে বিক্রি করছি সাত টাকা থেকে আট টাকা কেজি দরে। তবে আগামী এক মাসের মধ্যে আলুর দাম বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’
নীলফামারী জেলা শিল্প ও বণিক সমিতির সাবেক সভাপতি আবদুল ওয়াহেদ সরকার বলেন, ‘জেলায় যে পরিমাণ আলু উৎপাদন হয়, তা স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলার চাহিদা পূরণ করে। কিন্তু কৃষকেরা আলুর দাম পান না। আমি মনে করি, এ অঞ্চলে সরকারিভাবে আলু সংরক্ষণের ব্যবস্থা এবং আলু দিয়ে তৈরি করা খাদ্যদ্রব্যের কারখানা স্থাপন করা প্রয়োজন। তাহলে আলুর ব্যবহার বাড়বে এবং আলুর তৈরি খাদ্যদ্রব্যও পাওয়া যাবে। এতে লাভবান হবেন আলু চাষিরা।’
নীলফামারী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক আফজাল হোসেন বলেন, এখন আলুর বাজারদর কম, কিন্তু এ অবস্থা বেশি দিন থাকবে না। যেভাবে হোক, আলু সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ, মুন্সিগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় বৃষ্টিপাত হয়েছে, সে কারণে ওই এলাকায় আলুর ভালো ফলন হয়নি। এসব বিবেচনা করে আলু সংরক্ষণ করে রাখলে মাস তিনেক পর ভালো দাম আসবে।’
আফজাল হোসেন আরও বলেন, জেলায় ১১টি হিমাগার রয়েছে। সেগুলোতে আলু রাখার পর্যাপ্ত জায়গা রয়েছে। এ ছাড়া সরকারিভাবে বিএডিসির বীজ উৎপাদন খামারে একটি বীজ হিমাগার স্থাপনের প্রক্রিয়া চলছে। সেটি হয়ে গেলে কৃষকেরা উপকৃত হবেন।
মুন্সিগঞ্জেও আগাম আলুর দাম কম
মুন্সিগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক খুরশীদ আলম বলেন, মুন্সিগঞ্জের জমি থেকে বন্যার পানি সরতে দেরি হয়। এ কারণে এই জেলা আলুর জন্য প্রসিদ্ধ হলেও আগাম আলুর চাষ তেমন হয় না। তবে এ বছর ৩০০ থেকে ৪০০ হেক্টর উঁচু জমিতে আগাম আলুর চাষ হয়েছিল। আলুর দাম পড়ে যাওয়ায় কৃষকেরা লোকসানের মুখে পড়েন।
আলুচাষি নাজির হোসেন বলেন, এবার তিনি ৮০ শতক জমিতে আগাম আলুর চাষ করেন। এতে তাঁর প্রায় ৫০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়। কয়েক দিন আগে জমি থেকে আলু তুলে সর্বসাকল্যে ওই জমির আলু মাত্র ১৭ হাজার টাকায় বিক্রি করেন।
একইভাবে ৫০ শতক জমিতে আলু চাষ করে লোকসানের মুখে পড়েছেন সদর উপজেলার আলুচাষি আকাশ মিয়া। তিনি বলেন, গত কয়েক বছরের তুলনায় নতুন আলুর দাম অনেক কম। জমি থেকে আলু উত্তোলনের পর সাত-আট টাকা দরে প্রতি কেজি আলু বিক্রি করতে হয়েছে। এতে লাভ তো দূরে থাক, তাঁকে লোকসান গুনতে হয়েছে।
(প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক,বগুড়া এবং প্রতিনিধি,নীলফামারী ও মুন্সিগঞ্জ)