খাগড়াছড়ি পানছড়ি উপজেলার লোগাং ইউনিয়নের দুর্গম সীমান্তবর্তী এলাকা দুদকছড়ায় হয়েছিল শান্তি বাহিনী ও সরকারের সঙ্গে সংলাপ এবং সমঝোতা বৈঠক। এর রেশ ধরে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি হয়। পার্বত্য চুক্তির লক্ষ্যে সংলাপ ছাড়াও দ্বিতীয় দফা অস্ত্র সমর্পণ অনুষ্ঠান হয়েছিল দুদকছড়াতেই। কথা ছিল, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়িত হলে উন্নয়নের ছোঁয়ায় বদলে যাবে দুদকছড়া। কিন্তু এখনো সেখানে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি।
লোগাং ইউনিয়নের ১৪টি ও চেঙ্গী ইউনিয়নের ৭টি গ্রাম নিয়ে দুদকছড়া। নব্বইয়ের দশকে একাধিকবার দুদুকছড়ায় তৎকালীন শান্তি বাহিনীর সশস্ত্র আন্দোলন বন্ধের লক্ষ্যে সরকারের প্রতিনিধিরা আলোচনায় বসেছিলেন। মন্ত্রী, সাংসদ, বুদ্ধিজীবী, সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার পদচারণে এলাকাটি মুখর ছিল সেই সময়। দুদকছড়া এসে অনেকেই তখন উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। বলা হয়েছিল, চুক্তির পরেই কলেজ, হাসপাতাল, স্লুইসগেট, স্মৃতি জাদুঘর ও রাস্তাঘাট নির্মাণ করা হবে। কিন্তু সেসব কিছুই বাস্তবায়িত হয়নি।
গত বৃহস্পতিবার সকালে পানছড়ি বাজার থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে দুদকছড়া এলাকায় গেলে দেখা যায়, মারমাপাড়া–দুদকছড়া সড়কটি এখনো ইট বিছানো রয়ে গেছে। সড়কের কয়েক জায়গায় ইটের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। সড়কে যে দুটি সেতু রয়েছে, তার একটির মাঝবরাবর ভেঙে গেছে। অপরটি সড়ক থেকে দুই ফুট উঁচু হওয়ায় কোনো গাড়ি সেটি দিয়ে চলাচল করতে পারে না। টিলাঘেঁষা যে স্থানে শান্তি বাহিনীর সঙ্গে সরকারের সংলাপ হতো, সেখানে তৈরি করা হয়েছে একটি দোকান। আর যে জায়গায় শান্তি বাহিনীর সদস্যদের দ্বিতীয় দফা অস্ত্র সমর্পণ অনুষ্ঠান হয়েছিল, সেখানে এখন চাষের জমি। কয়েক বছর আগে বিদ্যুৎ এলেও অধিকাংশ পরিবার বিদ্যুৎ–সুবিধা পায়নি।
পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক গবেষক ও পর্যটকদের অনেকে পার্বত্য চুক্তির স্মৃতিবিজড়িত স্থান দুদকছড়া দেখতে আসেন। অনেকেই হতাশ হয়ে ফিরে যান দুদকছড়ার এমন দুরবস্থা দেখে।
সম্প্রতি দুদকছড়া দেখতে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সাদিয়া আফরোজ, নরেন চৌধুরী, ইকবাল বাহার, সাইফিনা আলমসহ ১২ জনের একটি দল। তাঁরা দুদকছড়া দেখে হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ‘পার্বত্য চুক্তির বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে লেখা পড়ে ও কথা শুনে অনেক আশা নিয়ে দুদকছড়া দেখতে এসেছি। পার্বত্য চুক্তির তথা পার্বত্য চট্টগ্রামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে দুদকছড়া অথচ তার কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই।’
দুদকছড়া এলাকার কার্বারি পূর্ণ জীবন চাকমা বলেন, পার্বত্য চুক্তির পর যেসব প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো কিছুই বাস্তবায়িত হয়নি। নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল গড়ে ওঠেনি। এলাকায় কেউ অসুস্থ হলে ছুটতে হয় ১৪ কিলোমিটার দূরে পানছড়ি সদর হাসপাতালে কিংবা খাগড়াছড়িতে নিয়ে যেতে হয়।
দুদকছড়া এলাকার ইউপি সদস্য বিজলী কুমার চাকমা বলেন, গ্রামগুলোতে এখনো পর্যাপ্ত পরিমাণে পানির সুব্যবস্থা নেই। পানীয় জলের অভাব সারা বছর লেগেই থাকে। তা ছাড়া শুষ্ক মৌসুমে সেচের পানির অভাবে জমিগুলো খালি পড়ে থাকে। চুক্তির পরে দুদকছড়াবাসী আশা করেছিল, আর কিছু না হোক, একটি দাবি তাদের পূরণ হবে। খালে একটি স্লুইসগেট নির্মাণ করে দেবে সরকার। এতে তাদের জমি চাষ করতে সুবিধা হবে।
পার্বত্য চুক্তির আগে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও সরকারের মধ্যস্থতাকারীদের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেছিলেন চিকনচান চাকমা ও সুমন চাকমা। তাঁরা বলেন, পার্বত্য চুক্তির সময় যেসব প্রতিশ্রুতি দুদকছড়াবাসীকে দেওয়া হয়েছিল, এর অধিকাংশ পূরণ হয়নি। তিন বছর আগে দুদকছড়ার কয়েকটি গ্রামে বিদ্যুৎ–সংযোগ দেওয়া হলেও অধিকাংশ গ্রামে এখনো বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি। অথচ চুক্তির সময় এ এলাকার মানুষ সাহায্য করেছিল সবচেয়ে বেশি।
লোগাং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান প্রত্যুত্তর চাকমা বলেন, পার্বত্য চুক্তি যে দুদকছড়ার সমঝোতার ফসল, এটি বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা ভুলতে বসেছে। চুক্তির সময় যেসব জুমঘর তৈরি করা হয়েছিল, সেগুলো ভেঙে গেছে। চেয়ার-টেবিলসহ নানা ধরনের যে জিনিসপত্র ব্যবহৃত হয়েছিল, সেগুলো সংরক্ষণের অভাবে বেশির ভাগ হারিয়ে গেছে বললেই চলে। একটি স্মৃতিস্তম্ভ অথবা স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণ করে দিলে সবাই পার্বত্য চুক্তির ইতিহাস জানতে পারবে।
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী বলেন, ‘দুদকছড়াবাসীর কাছে কী প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, সে সম্পর্কে আমার জানা নেই। এরপরও স্মৃতিস্তম্ভ অথবা স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণে সামনে অর্থবছরে ভাবা হবে।’