ছোটবেলায় ফুফুর বকা খেয়ে অভিমান করে বাড়ি ছেড়ে নিখোঁজ হন আবদুল কুদ্দুস মুন্সি। ১০ বছর বয়সে হারিয়ে যাওয়া সেই ছেলের বয়স এখন ৮০ বছর। বয়সের ভারে ক্লান্ত। কিন্তু হঠাৎই সেই ক্লান্তি যেন মিশে গেছে। সে জায়গায় শুধু স্বস্তি আর ভালো লাগার ছাপ। দীর্ঘ ৭০ বছর পর তিনি যে আবারও খুঁজে পেয়েছেন চিরচেনা সেই আপন ঠিকানা।
রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার ঝিকরা ইউনিয়নের বারুইপাড়া গ্রামে বসবাস করেন বৃদ্ধ আবদুল কুদ্দুস। গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় তাঁকে নিয়ে আপন ঠিকানা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার বাড্ডা গ্রামে রওনা দিয়েছেন তাঁর আত্মীয়সহ কয়েকজন স্থানীয়। সেখানে তাঁর দেখা হবে শতবর্ষী বৃদ্ধ মা আমরো বেওয়া ও অন্যান্য আপনজনের সঙ্গে।
গত ১২ এপ্রিল আইয়ুব আলী নামে আত্রাইয়ের সিংসাড়া বাজারের পরিচিত একজন দোকানি তাঁর ফেসবুক আইডিতে আবদুল কুদ্দুসকে নিয়ে একটি ভিডিও পোস্ট করেন। সেখানে তাঁর বাবা, গ্রাম ও উপজেলার নাম উল্লেখ করে আপনজনের সন্ধান চাওয়া হয়। একপর্যায়ে তাঁদের সন্ধান মিলেও যায়। এরপর কয়েকজন আত্মীয় ২১ সেপ্টেম্বর একটি বেসরকারি টেলিভিশনের প্রতিনিধিকে সঙ্গে নিয়ে বাগমারার বারইপাড়া গ্রামে আসেন। সেখানে ছোটবেলায় হারিয়ে যাওয়া ছোট্ট ছেলে আবদুল কুদ্দুসকে তাঁরা চিনতে পারেন। তিনিও চিনে ফেলেন তাঁদের কয়েকজনকে।
গতকাল সকালে আবদুল কুদ্দুসের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিনিধির। ছোটবেলায় হারিয়ে যাওয়ার স্মৃতিচারণা করে তখন আবদুল কুদ্দুস বলেন, তাঁর ফুফা পুলিশের দারোগা ছিলেন। বাগমারা থানায় কর্মরত থাকা অবস্থায় তাঁর কাছেই থাকতেন তিনি। একদিন ফুফুর বকুনি খেয়ে বাড়ি থেকে অজানা গন্তব্যে বেরিয়ে যান। ঘুরতে ঘুরতে চলে যান নওগাঁর আত্রাইয়ের সিংসাড়া গ্রামে। সেখানে একজন নারীর আশ্রয়ে ছিলেন বেশ কিছুদিন। এরপর চলে যান ওই এলাকারই দুই বোন সুন্দরী ও কপিজানের আশ্রয়ে। তাঁদের যত্নে বেড়ে উঠে আত্রাইয়ের চৌবাড়ি গ্রামে বিয়ে করেন। তাঁর ঘরে জন্ম নেয় তিন ছেলে ও চার মেয়ে। একসময় স্ত্রী মারা যান। এরপর দ্বিতীয় বিয়ে করেন বাগমারার বারুইপাড়া গ্রামে। থেকে যান সেখানে।
আবদুল কুদ্দুসের একজন স্বজন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা দুই ভাইবোন। ছেলে হারানোর শোকে একসময় বাবা মারা গেছেন। তবে মা (১১০) ও বোন (৬৭) বেঁচে আছেন। আবদুল কুদ্দুস হারিয়ে যাওয়ার পর তাঁর পুলিশ কর্মকর্তা ফুফাও কোনো দিন এলাকায় যাননি। তিনিও মারা গেছেন।
আত্রাইয়ের ব্যবসায়ী আইয়ুব আলী মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, তিনি আবদুল কুদ্দুসকে আগে থেকে চিনতেন ও মামা বলে ডাকতেন। তাঁর জীবনের গল্প জানার পর অনুমতি সাপেক্ষে তাঁকে নিয়ে ফেসবুকে একটি ভিডিও পোস্ট দেন। পোস্টটি তাঁর আপনজনের নজরে আসে। এরপর সন্ধান পাওয়া যায় তাঁর আপন ঠিকানার। আইয়ুব আরও বলেন, তিনি আশায় ছিলেন আবদুল কুদ্দুসের স্বজনদের পরিচয় একদিন পাওয়া যাবেই। তাই বলে মাত্র সাড়ে চার মাসে পাওয়া যাবে, ভাবেননি।
বাগমারার একজন ইউপি সদস্য আবুল কাশেম বলেন, আবদুল কুদ্দুস বয়সে চার–পাঁচ বছরের বড় হলেও তাঁরা বন্ধুর মতো। তাঁর কাছ থেকে হারিয়ে যাওয়ার গল্প শুনেছেন। তিনি আপনজনকে ফিরে পাওয়ার কথা কখনো আশা করেননি। তাঁর গ্রামে আবদুল কুদ্দুস চাষাবাদ করে সংসার চালাতেন। তাঁর এ গ্রামে ভালোই আছেন আবদুল কুদ্দুস। তারপরও এত বছর পর তিনি আপন ঠিকানা খুঁজে পেয়েছেন জেনে তাঁদের ভালো লাগছে। তাঁকে সেই ঠিকানায় পৌঁছে দিতে তিনিও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাড্ডা গ্রামে যাচ্ছেন।
এদিকে বৃদ্ধ আবদুল কুদ্দুস বলেন, এভাবে আপনজনের ঠিকানা পাওয়া যাবে এবং দীর্ঘ ৭০ বছর পর আবার মাকে দেখতে পাবেন, তা ভাবতেও পারেননি। বলেন, ২১ সেপ্টেম্বর আত্মীয় পরিচয়ে কয়েকজন বাগমারায় তাঁর বাড়িতে আসেন। কথাবার্তায় তাঁর ছোটবেলার অনেক তথ্য মিলে যায়। একসময় মুঠোফোনে ভিডিও কলের মাধ্যমে বৃদ্ধা মাকে দেখেন। কথা বলেন। এখন মাকে কাছে পাওয়ার অধীর অপেক্ষায়।