অক্টোবরেই চালু হয়েছে ৮৭৪ কোটি টাকার নান্দনিক সড়ক। এখন উড়ালসড়ক নির্মাণ করে কিশোরগঞ্জ সদরের সঙ্গে ঘটানো হবে সংযোগ।
কিছুদূর পরপর দ্বীপের মতো ভেসে থাকা গ্রাম, হিজলবন। তার পাশ দিয়ে যেন এঁকেবেঁকে চলে গেছে এক কালো রেখা। সেটি আসলে হাওরের বুকে দিগন্তে হারিয়ে যাওয়া পিচঢালা পথ। বর্ষায় যেখানে ঢেউ আছড়ে পড়ার শব্দ শোনা যায়। বলা হচ্ছে সম্প্রতি চালু হওয়া ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রামের মধ্যে নির্মিত সড়কের কথা। সড়কটি চালু হওয়ার আগেই গত বর্ষায় সেখানে দর্শনার্থীদের ভিড় লেগে গিয়েছিল।
সেই চোখজুড়ানো সড়কটি আদতে পূর্ণতা পায়নি। কারণ, এর সঙ্গে কিশোরগঞ্জ সদর তথা সারা দেশের মধ্যে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হয়নি। ফলে যানবাহনের চলাচলও খুব সীমিত। ৮৭৪ কোটি টাকার এই সড়কের প্রধান বাহন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও ইজিবাইক।
অপূর্ণতা ঢাকতে এবার হাওরে নির্মাণ করা হবে উড়ালসড়ক। এর জন্য নতুন প্রকল্প নিতে যাচ্ছে সেতু বিভাগ। এই প্রকল্প প্রাথমিক পর্যায়ে থাকলেও তা বাস্তবায়নে সরকারের উচ্চপর্যায়ের তাগিদ আছে বলে সেতু বিভাগ সূত্র জানিয়েছে। এ জন্য গত তিন মাসে দুই দফা সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা ঘুরে এসেছেন প্রকল্প এলাকা। এ প্রকল্পের মাধ্যমে কিশোরগঞ্জের মিঠামইনে নির্মাণাধীন সেনানিবাসকেও যুক্ত করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
অবশ্য সেতু বিভাগের দুজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, নতুন নির্মাণ করা হাওরের সড়কে যানবাহন চলাচল খুবই কম। উড়ালসড়ক নির্মাণের পর যানবাহন কতটা বাড়বে, এরও কোনো সমীক্ষা নেই। বিপুল অর্থ বিনিয়োগের অর্থনৈতিক সুফল কী হবে, সেটাও কেউ জানে না। এ ধরনের অনিশ্চিত প্রকল্পে বিদেশিরা অর্থায়ন করে না। তাই সরকারের রাজস্ব খাত থেকেই ব্যয় করতে হবে।
কিশোরগঞ্জ সদর থেকে ভাটিভাঙাটিয়া পর্যন্ত সড়কটি সরু, এর কিছু অংশ কাঁচা। ফলে এর সংস্কার করতে হবে। এই পথে উড়ালসড়কের দৈর্ঘ্য হবে ১০ দশমিক ৫৯ কিলোমিটার
সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, কমবেশি ১১ কিলোমিটার উড়ালসড়ক নির্মিত হলে হাওরের সড়ককে কিশোরগঞ্জ সদরের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত করা যাবে। এই উড়ালসড়ক নির্মাণে নকশা প্রণয়ন এবং সম্ভাব্যতা যাচাই এবং আনুষঙ্গিক অন্যান্য পরিকল্পনা প্রণয়নে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়কে (বুয়েট) পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হবে। এ বিষয়ে বুয়েটের কাছে ইতিমধ্যে প্রস্তাব চাওয়া হয়েছে। সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা মনে করছেন, উড়ালসড়ক নির্মাণে চার হাজার কোটি টাকা খরচ হতে পারে। পুরো টাকা সরকারের রাজস্ব খাত থেকে ব্যয় করা হবে। গত অক্টোবরে চালু হওয়া হাওরের নতুন সড়কটিরও ব্যয় নির্বাহ হয় রাজস্ব খাত থেকে।
প্রকল্প সম্পর্কে সেতু বিভাগের সচিব মো. বেলায়েত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, হাওরের সড়ক ইতিমধ্যে মানুষের দৃষ্টি কেড়েছে। তবে এর পূর্ণাঙ্গ সদ্ব্যবহার হচ্ছে না। উড়ালসড়ক নির্মিত হলে কিশোরগঞ্জ সদর তথা সারা দেশের সঙ্গে হাওরের তিন উপজেলার স্থায়ী সড়ক যোগাযোগ তৈরি হবে।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের ইচ্ছায় ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রামের মধ্যে প্রায় ৩০ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে প্রকল্প নেওয়া হয়। ২০১৬ সালে নির্মাণকাজের উদ্বোধনও করেন রাষ্ট্রপতি। এই সড়কের সঙ্গে কিশোরগঞ্জ ও সারা দেশের সরাসরি সংযোগ স্থাপনের আগ্রহের কথা রাষ্ট্রপতিই জানিয়েছেন। এরপরই সেতু বিভাগ উড়ালসড়ক নির্মাণে তৎপর হয়।
হাওরের সড়ক ইতিমধ্যে মানুষের দৃষ্টি কেড়েছে। তবে এর পূর্ণাঙ্গ সদ্ব্যবহার হচ্ছে না। উড়ালসড়ক নির্মিত হলে কিশোরগঞ্জ সদর তথা সারা দেশের সঙ্গে হাওরের তিন উপজেলার স্থায়ী সড়ক যোগাযোগ তৈরি হবে।বেলায়েত হোসেন, সেতু বিভাগের সচিব
ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রামে হাওরের বুকে নান্দনিক সড়কটি গত ৮ অক্টোবর ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বর্ষায় ডুবে যায়, শুকনো মৌসুমে চলাচলের উপযোগী সড়ক হাওরে আছে। কিন্তু নতুন সড়কটি উঁচু এবং সারা বছরই যাতায়াতের সুযোগ তৈরি করেছে। এ জন্য এটিকে ‘অল ওয়েদার’ সড়ক বলা হচ্ছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘হাওরে যে এমন সড়কপথ করা যায়, সেটাও মহামান্য রাষ্ট্রপতি শিখিয়েছেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতির ইচ্ছানুযায়ীই হাওরবাসীর এ স্বপ্নপূরণে আমরা কাজ শুরু করি।’
গত ১৯ নভেম্বর সেতু বিভাগের ছয় সদস্যের দল ঘুরে এসে উড়ালসড়কের জন্য তিনটি সম্ভাব্য পথের প্রস্তাব করে। এর মধ্যে মূল বিবেচনায় আছে মরিচখালী-ভাটি বরাটিয়া-মিঠামইন পথ।
পরিদর্শক দল সূত্র বলছে, কিশোরগঞ্জ সদর থেকে ভাটি বরাটিয়া পর্যন্ত এলজিইডির সড়ক আছে। এটির সঙ্গে সংযোগ আছে নিকলী উপজেলারও। তবে সড়কটি সরু, এর কিছু অংশ কাঁচা। ফলে এর সংস্কার করতে হবে। এই পথে উড়ালসড়কের দৈর্ঘ্য হবে ১০ দশমিক ৫৯ কিলোমিটার।
চোখজুড়ানো সড়কটি আদতে পূর্ণতা পায়নি। ৮৭৪ কোটি টাকার এই সড়কের প্রধান বাহন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও ইজিবাইক।
হাওরে উড়ালসড়ক নির্মাণের বিষয়ে বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক খান এম আমানত প্রথম আলোকে বলেন, হাওরে যেভাবে সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে, তাতে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এর ক্ষতিকর প্রভাব আছে। চলনবিল দিয়ে সড়ক নির্মাণের ফলেও একই প্রভাব পড়েছে। এ জন্যই হাওরের সড়কের সঙ্গে উড়ালসড়কের মাধ্যমে সংযোগ ঘটানোই ভালো। এতে পানির প্রবাহ ঠিক থাকবে। জীববৈচিত্র্যে প্রভাব ফেলবে না। তবে তিনি বলেন, উড়ালসড়ক নির্মাণে যে ব্যয় হবে, তা উঠিয়ে আনার সম্ভাবনা নেই। অর্থাৎ আর্থিকভাবে প্রকল্পটিকে কোনোভাবেই যৌক্তিক বলা যাবে না। তবে সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে, একটি অঞ্চলের মানুষের সুবিধা বিবেচনা করে এটা করা যেতে পারে।