একসঙ্গে ৫ ছেলের মৃত্যু

অধিক শোকে পাথর মানু রানী সুশীল

স্বামীকে হারানোর মাত্র ১০ দিনের মাথায় একসঙ্গে পাঁচ সন্তানকে হারিয়েছেন মানু রানী সুশীল। গতকাল দুপুরে কক্সবাজারের চকরিয়ায় নিজ বাড়িতে
ছবি: প্রথম আলো

কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার হাসিনাপাড়া গ্রামের মানু রানী সুশীল (৭০) মাত্র ১০ দিন আগে স্বামীকে হারিয়েছেন। আর গত মঙ্গলবার একসঙ্গে হারান পাঁচ ছেলেকে। তাঁর তিন সন্তান হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এর মধ্যে এক ছেলের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই স্বামীর শ্রাদ্ধের মূল কাজ তাঁকেই সম্পন্ন করতে হয়েছে। একই সঙ্গে সামলাতে হচ্ছে শোকে বিহ্বল পুত্রবধূ ও নাতি–নাতনিদেরও।

গতকাল বুধবার অনুষ্ঠিত হয় মানু রানীর স্বামী সুরেশ চন্দ্র সুশীলের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান, যিনি গত ৩০ জানুয়ারি মারা যান। শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে মানু রানীসহ পরিবারের কয়েক সদস্য অংশ নেন।

মঙ্গলবার ভোরে পিকআপ ভ্যানের চাপায় নিহত হন সুরেশ চন্দ্রের পাঁচ ছেলে অনুপম সুশীল (৪৬), নিরুপম সুশীল (৪০), দীপক সুশীল (৩৫), চম্পক সুশীল (৩০) ও স্মরণ সুশীল (২৯)। গুরুতর আহত রক্তিম সুশীল (৩২) চট্টগ্রাম নগরের একটি বেসরকারি হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে রয়েছেন। আরেক ছেলে প্লাবন সুশীল (২৫) চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ও মেয়ে হীরা সুশীল (২৮) চকরিয়ার মালুমঘাট খ্রিস্টান মেমোরিয়াল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। সুরেশ–মানু দম্পতির ৯ সন্তানের মধ্যে একমাত্র সুস্থ রয়েছেন মুন্নী সুশীল (২৩)। তিনিও দুর্ঘটনাস্থলে ছিলেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, বাড়ির আঙিনার এক কোণে দাঁড়িয়ে কান্নাকাটি করছিলেন নিহত অনুপমের স্ত্রী পপী সুশীল (৩৫)। পাশে দাঁড়ানো তাঁর এক ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়ে দেবত্রী সুশীল (১৫) জানায়, বাবার মৃত্যুর পর থেকে মায়ের কান্না থামছে না। মুখেও কিছু তুলছেন না। পল্লিচিকিৎসক ছিলেন অনুপম সুশীল।

আঙিনায় আরেক পাশে নির্বাক দাঁড়িয়ে ছিলেন পূজা সুশীল (২৬)। তিনি নিহত দীপক সুশীলের স্ত্রী। পূজার পাশে তাঁর একমাত্র ছেলে আয়ূশ সুশীল (৬)। পূজা সুশীল বলেন, তাঁর স্বামী দীপক কাতারে ছিলেন। সেখানে তাঁর একাধিক দোকান ছিল। এখন কাতারের দোকানের খবর নেওয়ার লোক নেই। আবার তাঁর হাতে স্বামীর রেখে যাওয়া কিছুই নেই। একমাত্র ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত তিনি।

গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে স্বামীর শ্রাদ্ধানুষ্ঠান শেষ হলে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন মানু রানী সুশীল। তিনি বাড়ির আঙিনায় স্বামীর শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের জন্য কিনে আনা মালামাল দেখিয়ে বলেন, আজ (গতকাল) দেড় হাজার মানুষকে খাওয়ানোর প্রস্তুতি ছিল। আঙিনায় শামিয়ানা টানানো হয়েছিল। কিন্তু একসঙ্গে পাঁচ সন্তানের মৃত্যুতে সবকিছু লন্ডভন্ড হয়ে গেল। এসব কথা বলতে গিয়ে মানু রানী আবার কান্নায় ভেঙে পড়েন। আবার তিনি নিজেকে সামলে উপস্থিত মানুষজনের সঙ্গে কথা বলেন। জানান, ১১ দিন পর নিহত পাঁচ ছেলের জন্য শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করা হবে। তিনি পাঁচ সন্তানের মৃত্যু রহস্য উদ্‌ঘাটনে তদন্তের দাবি করেন।

পরিকল্পিত হত্যার দাবি

দুর্ঘটনাস্থল থেকে অক্ষত অবস্থায় ফেরা মুন্নী সুশীলের (২৩) ভাষ্য, সড়কের পাশে তাঁর ভাইবোনদের যে পিকআপ ভ্যান চাপা দেয়, সেটি চাপা দেওয়ার পর কয়েক ফুট দূরে গিয়েছিল। এরপর পেছন দিকে গাড়ি এনে আহত ভাইবোনদের আবার চাপা দেয়। তাঁর এই বক্তব্যের সূত্র ধরে সুরেশ পরিবার বলছে, এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। তবে স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের কয়েকজন জানান, সুরেশের পরিবারের সঙ্গে কারও বিরোধ কিংবা ঝুটঝামেলা নেই। তবে চালককে ধরা গেলে মূল রহস্য উদ্‌ঘাটন সম্ভব হতো।

পিকআপ জব্দ, চালক লাপাত্তা

চকরিয়া থানার ওসি মো. ওসমান গনী বলেন, মঙ্গলবার রাতে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের ডুলাহাজারা এলাকার রঙমহল এলাকার জঙ্গল থেকে পিকআপ ভ্যানটি জব্দ করেছে পুলিশ। কিন্তু গতকাল বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত চালক বা সংশ্লিষ্ট অন্য কাউকে আটক করা যায়নি। এ ঘটনায় মঙ্গলবার রাতে চকরিয়া থানায় অজ্ঞাতনামা কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। চকরিয়ার মালুমঘাট হাইওয়ে থানার পুলিশ পরিদর্শক শেফায়েত হোসেন বলেন, পিকআপ ভ্যানের চালক-হেলপার ও মালিককে শনাক্তের কাজ চলছে। জব্দ পিকআপ ভ্যানে দুই বস্তা আলু পাওয়া গেছে। তিনি বলেন, গাড়িটি আহত ব্যক্তিদের দ্বিতীয় দফায় চাপা দিয়েছে এমন তথ্যের এখনো প্রমাণ মিলছে না।

মানু রানীর স্বামী সুরেশ চন্দ্র সুশীল চকরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক ছিলেন। ১০-১২ বছর আগে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। তাঁদের স্থায়ী ঠিকানা কুতুবদিয়া উপজেলার আলী আকবরডেইল উপকূলে। ১৯৯১ সালের প্রলংয়করী ঘূর্ণিঝড়ে সহায়–সম্বল হারিয়ে সুরেশ চন্দ্র সুশীল চকরিয়ার হাসিনাপাড়ায় আশ্রয় নেন। এখানে ছয় ছেলেমেয়ের জন্ম। হাসিনাপাড়ায় বন বিভাগের জমিতে বসতি করছে শতাধিক জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবার। তার মধ্যে সুরেশসহ ৩০টি হিন্দু পরিবার আছে। গতকাল দুপুরে চকরিয়ার ইউএনও জেপি দেওয়ান নিহত পাঁচ ভাইয়ের পরিবারকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২৫ হাজার টাকা করে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা দেন। নিহত ব্যক্তিদের মা মানু রানীকে ২০ হাজার টাকা দেন স্থানীয় সাংসদ জাফর আলম।