রাজধানীর মহাখালী এলাকায় আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) হাসপাতালের সামনে ২৪ ঘণ্টা গাড়ি আর রোগীর জটলা লেগে আছে। রাজধানীতে হঠাৎ ডায়রিয়াজনিত রোগের প্রকোপ দেখা দেওয়ায় হাসপাতালে রোগীর চাপ বেড়েছে। রোগীদের প্রায় ১০ শতাংশ কলেরা নিয়ে হাসপাতালে আসছে।
হঠাৎ কেন রাজধানীতে ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দিল, তার অনুসন্ধানে নেমেছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। অন্যদিকে গত পরশু জাতীয় কলেরা টাস্কফোর্সের জরুরি সভা হয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার বেলা দুইটার সময় আইসিডিডিআরবির হাসপাতালে ভর্তি হন কাচের মিস্ত্রি মাহফুজ। বাসা ঢাকার শেওড়াপাড়া এলাকায়। এক বাসায় তিনজন মেস করে থাকেন। সোমবার গভীর রাত থেকে তাঁর পাতলা পায়খানা শুরু হয়। ২০-২১ বার পাতলা পায়খানা হওয়ার পর তিনি দুর্বল হয়ে পড়েন। পরে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
মাহফুজের পাশের শয্যায় রয়েছেন এক নারী। তাঁর বাসা রাজধানীর বাড্ডা এলাকায়। জানা গেল, বেশ কয়েকবার পাতলা পায়খানা হওয়ার পর তাঁর বমি শুরু হয়। প্রতিবেশী এক নারী তাঁকে হাসপাতালে এনেছেন। চিকিৎসকেরা এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, দুজনেরই পরিস্থিতি খারাপ ছিল। ১০ থেকে ১২ ঘণ্টার মধ্যে দুজনের পরিস্থিতি ভালো হয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
হঠাৎ পরিস্থিতি খারাপ
দেশে সারা বছরই মানুষ কমবেশি ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়। আইসিডিডিআরবির হাসপাতাল শাখার প্রধান বাহারুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, বছরের এ সময়ে দৈনিক গড়ে ৫০০ রোগী ভর্তি হয়। কিন্তু গত কয়েক দিনে হঠাৎ রোগী বেড়েছে। ৩০ মে রোগী ছিল ৬৫৩ জন, ৩১ মে রোগী বেড়ে হয় ৯৫১ জন। এখন প্রতিদিন ১ হাজার ২০০–এর বেশি রোগী ভর্তি হচ্ছে।
সোমবার ২৪ ঘণ্টায় ১ হাজার ২২১ জন রোগী ভর্তি হয়েছিল। গতকাল বেলা দুইটা পর্যন্ত, অর্থাৎ প্রথম ১৪ ঘণ্টায় রোগী ভর্তি হয়েছিল ৫৬৪ জন। হাসপাতাল থেকে জানানো হয়েছে, সবচেয়ে বেশি রোগী আসছে রাজধানীর কাফরুল, বাড্ডা ও মিরপুরের কিছু এলাকা থেকে।
হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে, ৩০ মে থেকে ১ জুন ৪৮ ঘণ্টায় প্রায় সাড়ে ৩ হাজার রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচ বছরের কম বয়সী রোগী ছিল ৪৫ শতাংশ। রোগীদের প্রায় ১০ শতাংশ ছিল কলেরার।
কলেরাও ডায়রিয়াজনিত রোগ। কলেরায় পাতলা পায়খানার সঙ্গে বমি হতে পারে। অতিদ্রুত শরীর পানিশূন্য হয়ে পড়ে। তীব্র পানিশূন্যতায় নানা জটিলতা দেখা দেয়। সময়মতো ঠিক চিকিৎসা না হলে মৃত্যু ঘটে।
সরকার কী করছে
কেন রাজধানীর কিছু এলাকায় হঠাৎ ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দিয়েছে, তা কেউ বলতে পারছেন না। হাসপাতালে হঠাৎ রোগী বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আইসিডিডিআরবি বিষয়টি সরকারের নজরে আনার উদ্যোগ নেয়। রোববার এ নিয়ে একটি সভা ডাকা হয়। এতে সরকারের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা, আইইডিসিআর, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা অংশ নেন।
আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সোমবার থেকে আমরা ঢাকার বেশ কয়েকটি এলাকায় অনুসন্ধান দল পাঠিয়েছি। আমরা কারণ জানার চেষ্টা করছি। খুব শিগগির আমরা তা জানতে পারব।’
অন্যদিকে গত সোমবার জাতীয় কলেরা টাস্কফোর্সের জরুরি সভা হয়েছে। এ বিষয়ে রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক শেখ দাউদ আদনান প্রথম আলোকে বলেন, ‘কাফরুল, বাড্ডাসহ মিরপুরের যেসব এলাকায় রোগের প্রকোপ দেখা দিয়েছে, আমরা সেসব এলাকায় ডায়রিয়ার বিষয়ে ক্যাম্পেইন শুরু করব।’ তিনি আরও বলেন, বিমানবন্দর এলাকায় অস্থায়ী যেসব খাবার হোটেল আছে, সেগুলো উচ্ছেদের বিষয়েও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
কী করণীয়
ডায়রিয়া, কলেরা পানিবাহিত রোগ। ডায়রিয়া থেকে দূরে থাকতে বিশুদ্ধ পানির ব্যবহার খুবই জরুরি। আইসিডিডিআরবির হাসপাতাল শাখার প্রধান বাহারুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, পানি ফুটিয়ে খেতে হবে। পানি ফোটানোতে কোনো সমস্যা থাকলে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ব্যবহার করতে হবে।
ডায়রিয়া হলে বারবার পাতলা পায়খানার কারণে শরীর থেকে পানি বের হয়ে যায়। তীব্র পানিশূন্যতা মৃত্যুরও কারণ হয়। এ জন্য প্রতিবার পায়খানার পর খাওয়ার স্যালাইন খেতে হয়। তবে স্যালাইনের পরিমাণ কী হবে, তা চিকিৎসক বা প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীদের কাছ থেকে জেনে নিতে হবে। শিশুদের স্যালাইন খাওয়ানোর ব্যাপারে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
ডায়রিয়া রোগীদের জন্য তৈরি করা পরামর্শপত্রে আইসিডিডিআরবি বলছে, ডায়রিয়া আক্রান্ত হলে ৬ মাস থেকে ৫ বছরের শিশুকে প্রতিদিন একটি করে জিংক ট্যাবলেট পানিতে গুলিয়ে ১০ দিন খাওয়াতে হবে। জিংক ট্যাবলেট ডায়রিয়া রোগজনিত জটিলতা কমায় এবং পরবর্তী সময়ে শিশুর ডায়রিয়া হওয়ার ঝুঁকি কমায়।
অন্যদিকে জনস্বাস্থ্যবিদেরা বহু বছর ধরে বলে আসছেন, রাস্তার পাশের অস্বাস্থ্যকর ও খোলা খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে, খাওয়ার আগে ২০ সেকেন্ড ধরে সাবানপানি দিয়ে হাত ধুতে হবে, পায়খানা করার পর অথবা শিশুর পায়খানা পরিষ্কার করার পর সাবান দিয়ে ভালো করে হাত ধুতে হবে। ডায়রিয়া আক্রান্ত ব্যক্তির পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার আগে তাকে চিকিৎসকের কাছে নিতে হবে অথবা হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে। আইসিডিডিআরবির হাসপাতাল ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে, এখানে বিনা মূল্যে সব বয়সী রোগীর চিকিৎসা হয়।