মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হলো, ইতিমধ্যে নেওয়া প্রকল্পে অর্থ ছাড়ের ক্ষেত্রে কাটছাঁট করা হবে।
কেনাকাটায় ব্যয় কমানোর নির্দেশনা প্রধানমন্ত্রীর।
গাড়ি কেনার বিষয়ে জোরালোভাবে মানা করে দেওয়া হয়েছে।
সরকারি গাড়ি নিয়ে অহেতুক ঘোরাঘুরি করা যাবে না।
ব্যয় কমাতে নানা পদক্ষেপের পর এবার উন্নয়ন প্রকল্পের বরাদ্দেও কাটছাঁটের পথে হাঁটল সরকার। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে কিছু প্রকল্পে কোনো অর্থ ছাড় দেওয়া হবে না। আবার কিছু প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ ২৫ শতাংশ কম দেওয়া হবে।
আওয়ামী লীগ সরকার টানা তিন মেয়াদ ধরে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ওপর জোর দিয়ে এসেছে। বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্প নিয়েছে। শুধু অবকাঠামো নয়, সব খাতেই অনেকটা উদারভাবে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এবার বৈশ্বিক ও দেশীয় অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট এমন দাঁড়িয়েছে যে সরকারকে উন্নয়ন প্রকল্পেও কাটছাঁট করতে হচ্ছে।
মন্ত্রিসভার বৈঠকে গতকাল সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় কমানোসহ আরও কিছু নির্দেশনা দেন। কোন প্রকল্পের জন্য কত শতাংশ টাকা খরচ করা যাবে, সেটিও তিনি সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছেন বলে জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম।
মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে সভাপতিত্ব করেন। বৈঠকের পরে সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে সিদ্ধান্তগুলো জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব। তিনি বলেন, বৈশ্বিক পরিস্থিতির বিষয়টি মাথায় রেখে ব্যয় কমানোর জন্য নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় কমানো ছাড়া আর যেসব নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তা হলো কেনাকাটায় ব্যয় কমানো, সরকারি গাড়ি নিয়ে অহেতুক ঘোরাঘুরি না করা এবং বিদেশভ্রমণে বিধিনিষেধ আরোপ।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, উন্নয়ন প্রকল্পগুলোকে এ, বি ও সি—এই তিন শ্রেণিতে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। এ শ্রেণির প্রকল্পগুলো অবিলম্বে বাস্তবায়ন প্রয়োজন। এগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ব্যয় করা যাবে। বি শ্রেণির প্রকল্পগুলোর জন্য ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত টাকা খরচ করা যাবে। আর সি শ্রেণির প্রকল্পগুলো আপাতত স্থগিত থাকবে।
সরকার গত ৯ জুন ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করে। এতে ৫৮ শতাংশই অনুন্নয়ন ব্যয়, অর্থাৎ বেতন, ভাতা, সুদ ইত্যাদি খাতেই খরচ হবে বাজেটের বড় অংশ। টাকার পরিমাণে যা ৪ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকার মতো। উন্নয়ন ব্যয়ের জন্য রাখা হয়েছিল ২ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকার মতো, যা মোট বাজেটের ৩৮ শতাংশ। সেখানেও কাটছাঁট হচ্ছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে আগেই জানা গিয়েছিল, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় চলতি ২০২২–২৩ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) প্রকল্পগুলোকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করে দিয়েছে। এর মধ্যে ৬৪৬টি প্রকল্প রাখা হয়েছে এ শ্রেণিতে। বি শ্রেণিতে রাখা হয় ৬৩৬টি প্রকল্প এবং সি শ্রেণিতে রাখা হয়েছে ৯০টি প্রকল্প।
এ তালিকা অনুযায়ী, এ শ্রেণিতে রাখা প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি (পিইডিপি ৪), নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে জাপানি বিনিয়োগকারীদের জন্য অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, প্রতিটি উপজেলায় একটি করে মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপন ইত্যাদি।
বি শ্রেণিতে রাখা প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে খুলনা জেলা কারাগার নির্মাণ, অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আবাসন নির্মাণ, মধুখালী থেকে কামারখালী হয়ে মাগুরা শহর পর্যন্ত ব্রডগেজ রেলপথ নির্মাণ, পাকিস্তানের ইসলামাবাদে বাংলাদেশ চ্যান্সারি কমপ্লেক্স নির্মাণ, সৌদি আরবের জেদ্দায় বাংলাদেশ চ্যান্সারি কমপ্লেক্স নির্মাণ, ভৈরব নদী পুনঃখনন, ৬৪ জেলার ছোট নদী খাল ও জলাশয় পুনঃখনন ইত্যাদি প্রকল্প।
সি শ্রেণির মধ্যে রয়েছে ভূমি ব্যবস্থাপনা স্বয়ংক্রিয়করণ বা অটোমেশন, শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং ও ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপন, প্রশিক্ষণ সুবিধাসহ বরিশাল জেলায় পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণ, কক্সবাজারের মোটেল প্রবালের জায়গায় পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণ, হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনে হেলিপোর্ট নির্মাণ, খুলনা শহরে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কনভেনশন সেন্টার নির্মাণ, জাতীয় উন্নয়ন প্রশাসন একাডেমির ভবন নির্মাণ, বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন ও প্রশিক্ষণকেন্দ্রের (বিপিএটিসি) প্রশিক্ষণ সক্ষমতা বাড়ানো ইত্যাদি প্রকল্প।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ৩ জুলাই প্রকল্পের শ্রেণি বিভাগ করে সব মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। গত দুই সপ্তাহে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রকল্পের অগ্রাধিকার তালিকা নিয়ে তাঁদের আপত্তি ছিল। তাঁরা বলছিলেন, তালিকা করার কাজটি মন্ত্রণালয়কে দিলেই ভালো হতো।
যেমন ভূমি মন্ত্রণালয় ৭ জুলাই পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে বলেছে, সি শ্রেণিতে রাখা চারটি প্রকল্পে অর্থ ছাড় বন্ধ করা হলে জনদুর্ভোগ বাড়বে। উল্লেখ্য, এডিপিতে এ মন্ত্রণালয়ের আটটি প্রকল্পের মধ্যে তিনটি এ, একটি বি ও চারটিকে সি শ্রেণিতে রাখা হয়। সি শ্রেণিতে থাকা চার প্রকল্প হলো ডিজিটাল ভূমি ব্যবস্থাপনা, মৌজা ও প্লটভিত্তিক ডিজিটাল ভূমি জোনিং, ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভূমি জরিপ করার জন্য ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের জরিপ পরিচালনা সক্ষমতা বাড়ানো এবং ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভূমি জরিপের মাধ্যমে তিনটি সিটি করপোরেশন, একটি পৌরসভা ও দুটি গ্রামীণ উপজেলার ডিজিটাল ভূমি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি।
মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে গতকাল সাংবাদিকেরা জানতে চান প্রকল্পের শ্রেণিবিভাগ কিসের ভিত্তিতে করা হয়েছে। জবাবে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, এগুলো সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ঠিক করবে। এটি হবে গুরুত্ব অনুযায়ী। যদি সংশ্লিষ্ট কোনো মন্ত্রণালয় মনে করে কোনো একটি প্রকল্পের শ্রেণি পরিবর্তন করা দরকার, তাহলে তারা অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে নির্ধারণ করবে।
উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় কমালে সরকারের ব্যয় কমবে ঠিকই, তবে দেশের অর্থনীতির গতিতে প্রভাব পড়ার আশঙ্কা থাকে। অবশ্য এখন ব্যয় কমানো দরকার বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান।
তিনি বলেন, সব জায়গায়ই সাশ্রয় দরকার। বিশেষ করে যেসব প্রকল্পে বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির প্রয়োজন হবে, সেগুলো বাস্তবায়ন শ্লথ করা ঠিকই আছে। তিনি আরও বলেন, যেসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে, সেসব প্রকল্প বাস্তবায়নে বাড়তি সময় যেন না লাগে, ব্যয় বাড়ানো যাতে না হয়, সেদিকেও নজর দরকার।
মন্ত্রিসভার বৈঠকে কেনাকাটার বিষয়েও নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, যেসব কেনাকাটা অবিলম্বে করার দরকার নেই, সেগুলো আপাতত স্থগিত থাকবে। যেমন গাড়ি কেনার কথা জোরালোভাবে মানা করে দেওয়া হয়েছে।
আর বৈদেশিক প্রশিক্ষণের বিষয়ে আগেই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব। তবে ক্রয়সংক্রান্ত (প্রকিউরমেন্ট) বিষয়ের অধীন বিদেশে যাওয়ার প্রয়োজন হলে তা যাওয়া যাবে বলে জানান তিনি। এ ছাড়া বৈদেশিক সাহায্যসংক্রান্ত বিষয়েও বিদেশে যাওয়ার সুযোগ আছে বলে জানান তিনি; অর্থাৎ প্রকিউরমেন্ট বিষয় ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে সরকারি টাকায় বিদেশ যাওয়া যাবে না। বিষয়টি তিনি আরও পরিষ্কার করতে গিয়ে বলেন, যেমন সরকারের টাকায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ১০ জন শিক্ষাসফরে যাবেন, এটা বন্ধ হবে।
মন্ত্রিসভার বৈঠক থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। পরিবহনে কৃচ্ছ্রসাধন বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সব জায়গায় কৃচ্ছ্রসাধন করতে হবে। মন্ত্রীদেরও প্রধানমন্ত্রী ভার্চ্যুয়ালি যোগাযোগ করতে বলেছেন। গাড়ি নিয়ে অত ছোটাছুটি করার দরকার নেই।
সরকারের ব্যয় কমানোর লক্ষ্যে প্রথম পদক্ষেপটি আসে গত মে মাসে। ১২ মে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর বন্ধের বিষয়ে পরিপত্র জারি করে অর্থ মন্ত্রণালয়। এরপর গত ১৯ জুন থেকে দোকান, বিপণিবিতান ও কাঁচাবাজার রাত আটটার পর বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়।
১৮ জুলাই তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) এবং জ্বালানি তেল আমদানি কমানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ১৯ জুলাই থেকে দিনে এক ঘণ্টা লোডশেডিং শুরু করা হয়। ২০ জুলাই সরকারি সব দপ্তরে বিদ্যুতের ২৫ শতাংশ ব্যবহার কমানো, জ্বালানি খাতের বাজেট বরাদ্দের ২০ শতাংশ কম ব্যবহারের ব্যবস্থা করাসহ নতুন আট দফা সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনা দেওয়া হয়।
সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়িত হচ্ছে কি না, ব্যয় সাশ্রয় হচ্ছে কি না, তা–ও দেখতে হবে। মূল্যায়ন হলে পদক্ষেপগুলো অব্যাহত রাখা দরকার কি না, নতুন কোনো পদক্ষেপের প্রয়োজন হবে কি না, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।