জাতীয় ঐক্যের আহ্বান নিয়ে ছাত্রনেতা, রাজনৈতিক দল ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে পৃথক বৈঠকে বসবেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এর অংশ হিসেবে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন তিনি।
বৈঠকের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা জানিয়েছেন, তাঁরা ভারতের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে করা সব চুক্তি প্রকাশের দাবি জানিয়েছেন। পাশাপাশি ড. ইউনূসের সামনে তাঁরা দেশের পরিস্থিতি, ক্যাম্পাসগুলোর পরিস্থিতি, সরকারকে নিয়ে দেশের মানুষ কী ভাবছে, আগামী দিনগুলোতে সরকারের কী করা উচিত, প্রশাসনিক ব্যবস্থা কী রকম চলছে—সেই ‘গ্রাউন্ড রিয়েলিটি’ (মাঠের বাস্তবতা) তুলে ধরেছেন। প্রধান উপদেষ্টা তাঁদের কথা শুনেছেন এবং নোট নিয়েছেন।
এদিকে বাসস জানায়, বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা শিক্ষার্থীদের বলেন, ‘খুচরাভাবে কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে আগে দেখা হয়েছে। আজকে অনেকের সঙ্গে দেখা হলো। ভালো হলো। তোমাদের কথা শুনতেই মূলত আজকে বসা। তোমরা সরকারের কাছে কী চাচ্ছ, আশাগুলো কী, পরামর্শ আছে কি না—এটি জানতে চাওয়া।’
অধ্যাপক ড. ইউনূস আরও বলেন, ‘তোমরা রাষ্ট্রের অভিভাবক, তোমাদের কারণেই রাষ্ট্র। এই ভূমিকা ভুলে যেয়ো না। নিজেদের ভূমিকা ভুলে যেয়ো না। অনেকে এখানে আছে, অনেকে নেই। যারা নেই, তারাও রাষ্ট্রের অভিভাবক। তোমাদের দায়িত্ব আছে রাষ্ট্র যেন ঠিক পথে চলে, যেন বিচ্যুত না হয়। এইটুকু মনে রাখলে রাষ্ট্র ঠিক থাকবে। নিজের অভিভাবকত্ব ভুলে যেয়ো না।’
ছাত্র–অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের কথা তুলে ধরে ড. ইউনূস বলেন, ‘যে ধ্বংসস্তূপ রেখে গেছে, সেখান থেকে বের হওয়া কঠিন। যেদিকে হাত দিই, সেদিকেই ভাঙাচোরা। এই ভাঙাচোরা পরিষ্কার করেই যাচ্ছি। কাজ শুরু করতে গিয়ে কঠিন পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে।’
রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে মঙ্গলবার সন্ধ্যা থেকে রাত সোয়া আটটা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত বৈঠকে অংশ নেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ, সদস্যসচিব আরিফ সোহেল, মুখ্য সংগঠক আবদুল হান্নান মাসউদ, মুখপাত্র উমামা ফাতেমাসহ বেশ কয়েকজন ছাত্রনেতা। এতে আরও উপস্থিত ছিলেন জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী, সদস্যসচিব আখতার হোসেন, মুখপাত্র সামান্তা শারমিন ও সদস্য সারজিস আলম। জানা গেছে, উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ও তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বৈঠকে ছিলেন।
বৈঠকের পর যমুনার ফটকে ছাত্রনেতারা সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, বৈঠকে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক, আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, শিক্ষা খাত, নতুন সংস্কার প্রস্তাব ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তাঁরা মাঠের বর্তমান অবস্থা প্রধান উপদেষ্টাকে জানানোর চেষ্টা করেছেন।
হাসনাত বলেন, ‘আমরা আমাদের জায়গা থেকে প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি, ভারত সরকারের সঙ্গে ফ্যাসিস্ট সরকারের যেসব গোপন চুক্তি হয়েছিল, সেগুলো যেন প্রকাশ করা হয়। ফেলানী হত্যাসহ সীমান্তে যত হত্যাকাণ্ড হয়েছে, সেগুলোর যেন বিচার নিশ্চিত করা হয় এবং পানির ন্যায্য হিস্যা যেন বাস্তবায়ন করা হয়।’ তিনি বলেন, তাঁরা ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ন্যায্যতার ভিত্তিতে রাখার কথা বলেছেন। দেশে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের তাগিদ দিয়েছেন।
বিশ্ব গণমাধ্যমে বাংলাদেশের গণ-অভ্যুত্থানকে ইসলামি মৌলবাদের উত্থান হিসেবে দেখানোর চেষ্টা হচ্ছে বলে উল্লেখ করে হাসনাত বলেন, বিষয়টা আসলে তা নয়। সব শ্রেণি-পেশার ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে এই অভ্যুত্থান হয়েছে। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এসব বিশ্বদরবারে আরও বেশি প্রচার করা, অপপ্রচারের জবাব দিতে ‘সেল’ গঠন করা ইত্যাদি বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তাঁদের আলোচনা হয়েছে।
আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনে হামলা প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে আরিফ সোহেল বলেন, ‘হাইকমিশন যেহেতু একটি দেশের সার্বভৌম স্থান হিসেবে পরিগণিত হয়, ফলে সেখানে যদি নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়, তাহলে একটা স্বাধীন ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যে প্রতিক্রিয়া থাকা উচিত, সেটাই আমরা প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি।’
আবদুল হান্নান মাসউদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের কাছ থেকে প্রধান উপদেষ্টা জানতে চেয়েছেন, দেশের কৃষক-মজুর, রিকশাশ্রমিক, গার্মেন্টস শ্রমিকেরা আমাদের নিয়ে কী ভাবেন এবং সরকার তাঁদের জন্য কীভাবে কী করতে পারে। আমরা দেশের পরিস্থিতি, ক্যাম্পাসগুলোর পরিস্থিতি এবং সরকারকে নিয়ে দেশের মানুষ কী ভাবছে, সামনের দিনে সরকারের কী করা উচিত, প্রশাসনিক ব্যবস্থা কী রকম ভাবে চলছে—গ্রাউন্ড রিয়েলিটিটা (মাঠের বাস্তবতা) প্রধান উপদেষ্টার কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।’
হান্নান মাসউদ আরও বলেন, ‘৫ আগস্টের আগে বাংলাদেশে যে জাতীয় ঐক্য তৈরি হয়েছিল, সেটা এখনো ভাঙেনি বলে আমরা মনে করি। সব রাজনৈতিক দল দেশের স্বার্থে একমত। দেশের স্বার্থে সব ছাত্রসংগঠনও একসঙ্গে কাজ করবে। আমরা সরকারকেও বলেছি উদ্যোগ নেওয়ার জন্য এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনও এই উদ্যোগ নিচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘এই দেশে হিন্দু-মুসলিম সবাই একসঙ্গে বসবাস করে। আমরা সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি, কথা বলছি। আশা করি, সামনে কোনো সংঘাত সৃষ্টি হবে না।’
এর আগে মঙ্গলবার বিকেলে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, বুধবার প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন ড. ইউনূস। বৃহস্পতিবার ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠক হবে। বৈঠকের উদ্দেশ্য হলো জাতীয় ঐক্য। ড. ইউনূস সবাইকে নিয়ে জাতীয় ঐক্যের ডাক দেবেন।
সাংবাদিকেরা বিস্তারিত জানতে চাইলে প্রেস সচিব বলেন, ‘ইদানীং কিছু ঘটনা নিয়ে অপতথ্য ছড়ানোর প্রয়াস আমরা দেখছি। অনেকাংশে দেখছি ভারতের গণমাধ্যম খুব আক্রমণাত্মকভাবে এই কাজগুলো করছে। এটার জন্য জাতীয়ভাবে ঐক্য তৈরি করে আমাদের বলতে হবে, তোমরা আসো, দেখো কী হচ্ছে। একই সঙ্গে আমাদের জাতীয় ঐক্যও ধরে রাখা, আমাদের জাতীয় ঐক্য এখানে খুব জরুরি।’
প্রেস সচিব বলেন, সবাই মিলে, ঐক্যবদ্ধভাবে এই অপতথ্যের বিরুদ্ধে প্রচারাভিযানে নামতে হবে।