শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে একাত্তরের আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে ‘বাংলাদেশ একাত্তর’ নামের এক সংগঠন। গতকাল রাজধানীর রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধে
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে একাত্তরের আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে ‘বাংলাদেশ একাত্তর’ নামের এক সংগঠন। গতকাল রাজধানীর রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধে

নীলনকশা জামায়াতের, বাস্তবায়নে আলবদর

ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়েছে, জামায়াতে ইসলামীর মস্তিষ্কপ্রসূত ঘাতক বাহিনী আলবদর বুদ্ধিজীবী নিধনের নীলনকশা বাস্তবায়ন করেছে।

মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় করা অন্তত তিনটি মামলার রায়ে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা, ষড়যন্ত্র, সহযোগিতা ও হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের নাম এসেছে। এর মধ্যে আলবদর নেতা আশরাফুজ্জামান ওরফে নায়েব আলী খান এবং চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের বিরুদ্ধে করা মামলার রায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বলেছেন, ‘জামায়াতে ইসলামীর মস্তিষ্কপ্রসূত ঘাতক বাহিনী আলবদর একাত্তরে বুদ্ধিজীবী নিধনের যে নীলনকশা বাস্তবায়ন করেছে, তা গোটা জাতির বুকে ক্ষত হয়ে আজও রক্ত ঝরাচ্ছে।’

১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল রায়ে আরও বলেছিলেন, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের হিংস্রতা মৌলিক মানবতাবোধের জন্য হুমকি। ইতিহাস বলে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নানা সময়ে বেসামরিক জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে নানা ধরনের নৃশংস আক্রমণ হয়েছে। কিন্তু ইতিহাস এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়নি, যেখানে জাতির বিবেক হিসেবে পরিচিত বুদ্ধিজীবীদের লক্ষ্য করে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে।

তিনটি মামলায় ট্রাইব্যুনালের রায়ে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গ এসেছে। এই তিন মামলায় চারজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে, যাঁরা বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনার পাশাপাশি মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধে জড়িত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির মতিউর রহমান নিজামী এবং দলটির সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অপর দুই আসামি আশরাফুজ্জামান ওরফে নায়েব আলী খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীন এখনো পলাতক। ২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর রায় ঘোষণার ৯ বছর পরও এই দুজনকে ফেরত আনা যায়নি।

শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আলীম চৌধুরীর মেয়ে অধ্যাপক ডা. নুজহাত চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে শাস্তিপ্রাপ্ত অপরাধীদের দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে। আগে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকাজ দুটি ট্রাইব্যুনালে চললেও এখন একটি ট্রাইব্যুনালে বিচারকাজ চলছে। তাই ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বাড়িয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার আরও গতিশীল করতে হবে, যাতে কোনো মানবতাবিরোধী অপরাধী বিচারের বাইরে না থাকে। সেই সঙ্গে সংগঠন হিসেবে জামায়াতকে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে, যাতে বাংলাদেশের মাটিতে এ ধরনের অপরাধীদের বিকাশ না ঘটে।

১৯৭১ সালে বুদ্ধিজীবী নিধনের পরিকল্পনার ক্ষেত্রে আশরাফুজ্জামান ‘চিফ এক্সিকিউটর’ এবং মুঈনুদ্দীন ‘অপারেশন ইনচার্জ’ ছিলেন বলে ট্রাইব্যুনালের রায়ে উল্লেখ করা হয়েছিল। স্বাধীনতার পরপর মুঈনুদ্দীন পাকিস্তানে চলে যান এবং এরপর সেখান থেকে লন্ডনে যান। অন্যদিকে আশরাফুজ্জামান নিউইয়র্কে থাকতেন বলে জানিয়েছেন ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার শীর্ষ একজন কর্মকর্তা।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ওই দুই পলাতক আসামিকে ফিরিয়ে আনতে সরকার চেষ্টা করছে বলে জানান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। গত শনিবার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ওই দুজনকে দেশে ফিরিয়ে আনতে সংশ্লিষ্ট দেশের বিধিবিধান পর্যালোচনা করে আনুষ্ঠানিকভাবে সে দেশের সরকারের কাছে দাবি জানানো হবে। নিয়ম ও আইনি দিকগুলো পর্যালোচনা শেষ পর্যায়ে রয়েছে।

ওই দুজনকে ফিরিয়ে আনতে সংশ্লিষ্ট দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে দাবি জানানো হবে, এমন কথা এর আগেও উল্লেখ করেছিলেন—এমন প্রশ্নে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘সাত-আট মাস যুক্তরাজ্যে স্থিতিশীল সরকার ছিল না, যে কারণে কিছুটা সময় নেওয়া।’

একাত্তর সালে ১৮ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যার ঘটনায় মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মোট ১১টি অভিযোগ আনা হয়েছিল, ট্রাইব্যুনালের রায়ে সব কটি প্রমাণিত হয়েছে। ১৮ জন বুদ্ধিজীবী হলেন দৈনিক ইত্তেফাক–এর তৎকালীন কার্যনির্বাহী সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেন, পিপিআইয়ের (পাকিস্তান প্রেস ইন্টারন্যাশনাল) প্রধান প্রতিবেদক সৈয়দ নাজমুল হক, দৈনিক পূর্বদেশ–এর প্রধান প্রতিবেদক এ এন এম গোলাম মোস্তফা, বিবিসির সাংবাদিক নিজাম উদ্দিন আহমেদ, শিলালিপির সম্পাদক সেলিনা পারভীন, দৈনিক সংবাদ–এর যুগ্ম সম্পাদক শহীদুল্লা কায়সার, অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক সিরাজুল হক খান, ড. মো. মুর্তজা, ড. আবুল খায়ের, ড. ফয়জুল মহিউদ্দিন, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, ক্লিনিক্যাল মেডিসিন ও কার্ডিওলজির অধ্যাপক ফজলে রাব্বী ও চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. আলীম চৌধুরী। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর দিবাগত রাত থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ওই বুদ্ধিজীবীদের অপহরণের পর হত্যা করা হয়। তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের মরদেহ পরে রায়েরবাজার ও মিরপুরের বধ্যভূমিতে পাওয়া গেছে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউর তাপস কান্তি বল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, বুদ্ধিজীবী হত্যা ও পরিকল্পনায় পৃথক তিন মামলায় চারজনকে দোষী সাব্যস্ত করে সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান করা হয়েছে। মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান বাদে বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনার পাশাপাশি মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধের দায়ে মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে।

বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের অন্যতম পরিকল্পনাকারী জামায়াতের সাবেক আমির নিজামীর ফাঁসি কার্যকর হয় ২০১৬ সালের ১০ মে রাতে। নিজামীর মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, আলবদর বাহিনী যে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল, তার ওপর নিজামীর প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ ছিল।

জামায়াতের অরেক নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর হয় ২০১৫ সালের নভেম্বরে। মুজাহিদের মামলায় ট্রাইব্যুনাল রায়ে বলেছিলেন, একাত্তরে ছাত্র সংঘের সদস্যরা আলবদর বাহিনীতে রূপান্তরিত হয়। মুজাহিদ ছাত্র সংঘের ঊর্ধ্বতন নেতা ছিলেন। ক্ষমতাধারী রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে আলবদর গঠন থেকে শুরু করে হত্যা-নিধনযজ্ঞের শেষ পর্যন্ত এই বাহিনীর ওপর মুজাহিদের কর্তৃত্ব ছিল।

শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর ছেলে তানভীর হায়দার চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, স্বাধীন বিচারপ্রক্রিয়ায় আশরাফুজ্জামান ও মুঈনুদ্দীনের অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল তাঁদের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। দুঃখবোধের জায়গা হচ্ছে, ৯ বছরেও তাঁদের দেশে ফিরিয়ে আনা যায়নি। দেশে ফিরিয়ে আনতে আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। এই প্রক্রিয়া দ্রুত শুরু করা জরুরি। একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর খুনিসহ মানবতাবিরোধী যেসব অপরাধী দেশের বাইরে আছেন, তাঁদেরও দ্রুত ফিরিয়ে আনতে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।