নির্বাক, নিস্তব্ধ হয়ে বসেছিলেন নাসির উদ্দিন। ক্ষণে ক্ষণে বিলাপ করছিলেন। মেয়ে আফনান নাসিরকে (২১) হাসপাতালে ভর্তি করার মুহূর্তটি বারবার মনে পড়ছিল তাঁর। ভয় পেয়ে গিয়েছিল মেয়েটি। আতঙ্কিত হয়ে বারবার তাঁকে প্রশ্ন করছিল, ‘আব্বু আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?’ সেই কথাগুলো যে এখন দুমড়েমুচড়ে দিচ্ছে ভেতরটা।
গতকাল বুধবার ৯ দিনের জ্বরে ভুগে মারা যান চট্টগ্রামের আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (আইআইইউসি) ইংরেজি বিভাগের তৃতীয় সেমিস্টারের ছাত্রী আফনান নাসির। ডেঙ্গুর শঙ্কায় দুবার পরীক্ষা করানো হলেও প্রতিবারই নেগেটিভ ফল আসে। গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় চট্টগ্রাম নগরের আগ্রাবাদে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় মৃত্যু হয় আফনানের।
গতকাল সন্ধ্যায় যে সময় আফনানের মৃত্যু হয়, ওই সময় হাসপাতালের আরেকটি ওয়ার্ডে জ্বর নিয়ে ভর্তি ছিল তাঁর ছোট ভাই আদনান কায়সারও (১৬)। বোনের জানাজায় অংশ নিতে আজ বৃহস্পতিবার হাসপাতাল থেকে ছুটে যায় সে গ্রামের বাড়িতে। চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার কুসুমপুরা বিনানিহারা গ্রামে দুপুরে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় আফনানকে।
আফনানের দাফনের পর দুপুরে কুসুমপুরা বিনানিহারা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির এক কোণে বসে আছেন শোকগ্রস্ত নাসির উদ্দিন। চার বছর ধরে দুরারোগ্য ক্যানসারে ভুগছিলেন এই ব্যবসায়ী ও ক্রীড়া সংগঠক। অসুস্থতার সময়টায় বাবার সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া মেয়ে আফনান। নিয়ম করে সময়মতো ওষুধ খাওয়ানো, ঢাকায় নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো—সব এক হাতেই সামাল দিতেন। মেয়ে যেন মায়ের ভূমিকা নিয়েছিল নাসিরের জীবনে। কিন্তু মা হয়ে ওঠা সেই মেয়েকেই হারিয়ে ফেললেন নাসির উদ্দিন।
নীরবতা ভেঙে হঠাৎ নাসির বলেন উঠলেন, ‘সবাই আছে, কিন্তু আমার মামণি নেই, এটা কী করে সইব?’ মেয়েকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর পর আশা করেছিলেন সব ঠিক হয়ে যাবে। সুস্থ হয়ে ফিরবে তাঁর মেয়ে। আবার তাঁর সেবাশুশ্রূষার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেবে মেয়েটি। তা তো হয়নি। উল্টো বাবার কাঁধেই উঠল পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী জিনিস, সন্তানের লাশের খাটিয়া। মেয়েকে চিরদিনের জন্য রেখে এলেন কবরে।
আফনানের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন ক্রীড়া সংগঠক। পটিয়া ব্রাদার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক। নগরের আগ্রাবাদে সিডিএ আবাসিক এলাকায় নিজের বাড়ি। ৮ আগস্ট ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে এসেছিলেন। এর মধ্যে ১৪ আগস্ট জ্বরে আক্রান্ত হয় ছেলে আদনান। ১৮ আগস্ট ছেলে-মেয়েদের নিয়ে শহরের বাসায় ফেরেন। ২২ আগস্ট মেয়ে আফনানের জ্বর শুরু হয়। ২৪ আগস্ট বাড়ির পাশের চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের চিকিৎসকদের দেখানো হয় ভাই-বোনকে। পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করা হয়। ডেঙ্গু নেগেটিভ আসে। বেশি অসুস্থ অনুভব করলে গত মঙ্গলবার আফনানকে হাসপাতালে নিয়ে যান। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর দুপুরে বাসার দিকে রওনা দেন। কিন্তু বাসায় যাওয়ার সময় সিঁড়িতে পড়ে যান আফনান। সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে আসা হয় হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। এরপরই নেওয়া হয় আইসিইউতে। পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় সন্ধ্যায় লাইফ সাপোর্টে রাখা হয় তাঁকে। এই অবস্থায় বুধবার সন্ধ্যায় মৃত্যু হয় তাঁর।
চিকিৎসার জন্য বাবাকে ঢাকায় আনা-নেওয়া, নিয়ম করে ওষুধ খাওয়ানো—এসবের কিছুতেই যাতে বিন্দুমাত্র অবহেলা না হয়, সেদিকে মেয়ে আফনানের ছিল তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। এসব বলতে গিয়ে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন নাসির উদ্দিন। মেয়ের এসব স্মৃতি যেন ভুলতেই পারছেন না। বিলাপ করতে করতে বলতে থাকেন, ‘আমি আর শহরের বাড়িতে যাব না। মেয়েকে ছাড়া ওই বাড়িতে থাকতে পারব না।’