ই–অরেঞ্জের পৃষ্ঠপোষক ও বরখাস্ত হওয়া বনানী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) শেখ সোহেল রানাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে পদক্ষেপ এবং ই-অরেঞ্জের লেনদেনের বিপরীতে রাজস্ব আদায়ের বিষয়ে জানিয়ে ১৯ ফেব্রুয়ারির মধ্যে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
স্বরাষ্ট্রসচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানসহ বিবাদীদের প্রতি এ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ আজ রোববার এ আদেশ দেন।
এক রিটের ধারাবাহিকতায় গত ৩ নভেম্বর হাইকোর্ট কয়েক দফা নির্দেশনাসহ আদেশ দেন। ই-অরেঞ্জ থেকে টাকা উত্তোলনকারীদের নাম-ঠিকানা উল্লেখ করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটসহ (বিএফআইইউ) তিন বিবাদীকে নতুন করে ৩০ দিনের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে শেখ সোহেল রানাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে এবং হলফনামা করে জানাতে স্বরাষ্ট্রসচিবকে নির্দেশ দেন। এ ছাড়া ই-অরেঞ্জের লেনদেনের বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছে কি না, সে বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানকে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
আগের ধারাবাহিকতায় আজ বিষয়টি আদালতে ওঠে। আজ দুদকের আইনজীবীর পক্ষে সময় চাওয়া হয়। রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী এম আবদুল কাইয়ুম। বিএফআইইউর পক্ষে আইনজীবী শামীম খালেদ আহমেদ শুনানিতে ছিলেন। আইজিপির প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন।
পুলিশের মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) প্রতিবেদন তুলে ধরে শুনানিতে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘শেখ সোহেল রানার (বরখাস্ত পুলিশ পরিদর্শক) বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি করা আছে। ১৬ জানুয়ারি পাওয়া তথ্য অনুসারে, ভারতে অবৈধ অনুপ্রবেশের কারণে শেখ সোহেল রানা (বরখাস্ত পুলিশ পরিদর্শক) তিন বছরের সাজাপ্রাপ্ত হয়ে প্রেসিডেন্সি কারেকশনাল হোম আলীপুর, ভারতে আটক ছিলেন। পত্রপত্রিকার খবরে দেখেছি, জামিন নিয়ে পরে সেখান থেকে সোহেল রানা পালিয়ে গেছেন। আইজিপিকে বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে, সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্য পেলে আদালতকে জানানো হবে। যেহেতু ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি করা আছে, গ্রেপ্তার না হলে ফিরিয়ে আনা যাচ্ছে না।’
বিএফআইইউর পক্ষে আইনজীবী শামীম খালেদ আহমেদ বলেন, ই-অরেঞ্জ সংশ্লিষ্টদের নাম–ঠিকানা ও ব্যাংক হিসাবের নম্বর দেওয়া আছে।
রিট আবেদনকারীদের আইনজীবী এম আবদুল কাইয়ুম বলেন, গত ৩ নভেম্বর হাইকোর্ট কয়েকটি নির্দেশনাসহ আদেশ দিয়েছিলেন। সোহেল রানাকে দেশে ফিরিয়ে আনার পদক্ষেপ নিতে এবং হলফনামা দিতে স্বরাষ্ট্রসচিবের প্রতি নির্দেশনা ছিল। তবে এটি বাস্তবায়ন করা হয়নি। ই-অরেঞ্জের লেনদেনের বিপরীতে ভ্যাট-ট্যাক্স আদায়ের বিষয়ে জানিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছিল।
আদালত বলেন, ‘জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান কোনো রিপ্লাই দেননি?’ তখন আবদুল কাইয়ুম বলেন, ‘না, মাই লর্ড।’ শুনানির একপর্যায়ে আদালত বলেন, ‘এই যে আদেশগুলো হয়, তার একটি পারপাস আছে। এটি যদি কাগজে–কলমে থেকে যায়, তাহলে সুফল পাওয়া যাবে না। কেননা দেশের কল্যাণে ও আরও ভালোর লক্ষ্যে আদেশ দেওয়া হয়।’
একপর্যায়ে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ করে আদালত বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট বিবাদী স্বরাষ্ট্রসচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানের সঙ্গে আপনি যোগাযোগ করেন। পরবর্তী তারিখে না পেলে কনটেম্পট রুল ইস্যু করে দেব।’
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আইজিপির পক্ষ থেকে একই রকম বিষয় (তথ্য) আসে সব সময়।’ আদালত বলেন, ‘দুজন তো দুই ব্যক্তি। তাই নয় কি?’
পরে আদালত আদেশ দেন। আদেশে বলা হয়, ই-অরেঞ্জ থেকে টাকা উত্তোলনকারীদের নাম–ঠিকানা, লেনদেনসহ ইতিপূর্বে ৩ বিবাদীকে ৩০ দিনের মধ্যে নতুন করে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। শেখ সোহেল রানাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে ও হলফনামা করে জানাতে স্বরাষ্ট্রসচিবকে এবং ই-অরেঞ্জের লেনদেনের বিপরীতে রাজস্ব আদায় বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানকে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। দুদকের পক্ষ থেকে সময় চাওয়া হয়, যা মঞ্জুর করা হলো। বিএফআইইউ-এর কমপ্লায়েন্স নথিভুক্ত করা হলো।
গত ৩ নভেম্বর দেওয়া আদেশ অনুসারে দুদক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ তিন বিবাদী হলফনামা করে কমপ্লায়েন্স দাখিল করেনি। এ অবস্থায় দুদক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ তিন বিবাদীকে গত ৩ নভেম্বর দেওয়া আদেশ বাস্তবায়ন করতে নির্দেশ দেওয়া হলো। এতে ব্যর্থ হলে আইন অনুসারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সংশ্লিষ্ট বিবাদীদের বিষয়টি জানাতে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলকে নির্দেশ দেওয়া হলো। বিষয়টি ১৯ ফেব্রুয়ারি কার্যতালিকায় আসবে।
পণ্য কিনে প্রতারণার শিকার দাবি করে ৫৪৭ জন গ্রাহকের পক্ষে তাঁদের ৬ জন প্রতিনিধি গত বছরের মার্চে হাইকোর্টে রিট করেন। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত ৭ এপ্রিল হাইকোর্ট রুলসহ আদেশ দেন। জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে অনুসন্ধান করে চার মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বিবাদীদের নির্দেশ দেওয়া হয়।
এরপর গত ৩ নভেম্বর বিএফআইইউ, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও পুলিশের মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) প্রতিবেদন আদালতে উপস্থাপন করা হয়। আইজিপির প্রতিবেদন সুস্পষ্ট নয় এবং দুদকের প্রতিবেদন সন্তোষজনক নয় বলে সেদিন উল্লেখ করে আদালত নতুন করে ৩০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশসহ আদেশ দিয়েছিলেন।