লাখ লাখ টাকা জমা রেখেছিলেন তাঁরা, এখন সংসারই চলছে না

পিরোজপুর শহরের বাইপাস সড়কে এই বহুতল ভবনে ছিল এহসান গ্রুপের প্রধান কার্যালয়
ছবি: প্রথম আলো

পিরোজপুরের ইন্দুরকানির বালিপাড়া গ্রামের বাসিন্দা হাবিবুর রহমান (৬৬) ও তাঁর স্ত্রী খাদিজা বেগম (৫৫) এহসান গ্রুপে ৩৪ লাখ টাকা আমানত রেখেছিলেন। ২০১৯ সালের জুলাই মাস থেকে প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকদের মাসিক মুনাফা ও আমানতের টাকা ফেরত দেওয়া বন্ধ করে দেয়। সারা জীবনের সঞ্চয় হারিয়ে হাবিবুর-খাদিজা দম্পতি এখন দিশেহারা। ধারদেনা ও জমি বিক্রি করে চলতে হচ্ছে তাঁদের। স্বামীকে নিয়ে খাদিজা এখন খুলনায় থাকেন। কিডনি জটিলতায় আক্রান্ত হাবিবুরের চিকিৎসা চলছে সেখানে।

হাবিবুর-খাদিজা দম্পতির মতো পিরোজপুর ও আশপাশের এলাকার ১০ হাজারের বেশি আমানতকারীর শতকোটি টাকা লোপাট করেছে এহসান গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটি চারটি সমবায় সমিতির নামে সঞ্চয় করা টাকা, ডিপিএস ও একটি রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় অংশীদার হিসেবে আমানতকারীদের কাছ থেকে গত এক দশকে এই টাকা তুলে নেয়।

এহসান গ্রুপ মূলত সুদবিহীন বিনিয়োগের প্রচার চালিয়ে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করত। ওয়াজ মাহফিল আয়োজনের মাধ্যমে ব্যবসায়িক প্রচার চালাত। এসব পুঁজি করে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নেয় প্রতিষ্ঠানটি। এহসান গ্রুপে সঞ্চয় করা টাকা ৫৪ মাস পর ২৫ শতাংশ এবং ৮ বছর পর দ্বিগুণ অর্থ ফেরত দেওয়া হবে এবং আমানতকারীদের প্রতি লাখে মাসে প্রায় দুই হাজার করে টাকা লভ্যাংশ দেওয়ার লোভ দেখিয়ে টাকা জমা নেওয়া হতো।

অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে গ্রেপ্তার হন এহসান গ্রুপের চেয়ারম্যান রাগীব আহসান

এ প্রতিষ্ঠান চালু করেছিলেন রাগীব আহসান নামের এক ব্যক্তি। তিনি ২০০৭ সালে ঢাকায় একটি এমএলএম কোম্পানিতে ৯০০ টাকা বেতনে চাকরি করতেন। পাশাপাশি করতেন ইমামতি। এমএলএম কোম্পানিতে চাকরির সুবাদে রপ্ত জ্ঞান থেকে এহসান গ্রুপ গড়ে তুলেছিলেন তিনি। পিরোজপুর শহরে কার্যালয় ছিল তাঁদের। এহসান গ্রুপের ‘প্রসপেক্টাসে’ দেখা যায়, তাদের সঞ্চয় ও ঋণদান, অবৈধ ক্যাডেট একাডেমি, রিয়েল এস্টেট ব্যবসা, তৈরি পোশাক ও প্রসাধনী ব্যবসা, সেনিটারি ও হার্ডওয়্যার ব্যবসা, মহিলা মাদ্রাসা, ইসলামি রিচার্স সেন্টার ইত্যাদি নামে মোট ১৭টি প্রতিষ্ঠান আছে। একসময়ে এসব প্রতিষ্ঠান চালু থাকলেও বর্তমানে বেশির ভাগেরই অস্তিত্ব নেই।

প্রতারণা ও জালিয়াতি করে গ্রাহকদের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে গত বছর ৯ সেপ্টেম্বর রাজধানীর তোপখানা রোড এলাকা থেকে এহসান গ্রুপের চেয়ারম্যান রাগীব আহসান ও তাঁর ভাই আবুল বাশার খানকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। এদিনই পিরোজপুর থানা-পুলিশ রাগীব আহসানের দুই ভাই মাহমুদুল হাসান ও খাইরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে।

ওই দিন পিরোজপুর সদর উপজেলার মূলগ্রাম গ্রামের বাসিন্দা হারুন অর রশিদ বাদী হয়ে রাগীব ও তাঁর চার ভাইকে আসামি করে মামলা করেন। তিনি ৯৭ গ্রাহকের ৯১ কোটি ১৫ লাখ ৫৫ হাজার ৯৩৩ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ করেন। ওই মামলায় গ্রেপ্তার চারজন এখন কারাগারে। অপর আসামি রাগীবের আরেক ভাই শামীম হাসানকে এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। গ্রাহকের অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় রাগীব আহসানসহ এহসান গ্রুপের উপদেষ্টা ও পরিচালকদের বিরুদ্ধে পিরোজপুরে এ পর্যন্ত ১৯টি মামলা হয়েছে। এসব মামলার বাদী সবাই প্রতিষ্ঠানটিতে টাকা আমানতকারী ও সেখানকার কর্মী।

যেভাবে প্রতারিত গ্রাহকেরা

পিরোজপুর পৌরসভার কুমারখালী মহল্লার অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী হেমায়েত উদ্দিন (৬৩) এহসান গ্রুপের চেয়ারম্যান রাগীবের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে করা একটি মামলার বাদী। তিনি জানান, ২০১৮ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসরে যান। সে সময় ১৬ লাখ টাকা পেয়েছিলেন তিনি। তার ১৫ লাখ টাকাই এহসান গ্রুপে জামানত রাখেন। প্রতি লাখে দুই হাজার টাকা লভ্যাংশ দেওয়ার কথা ছিল। ভ্যাট কেটে দেওয়া হতো ১ হাজার ৭০০ টাকা। এক বছর পর লভ্যাংশ দেওয়া বন্ধ হয়।

হেমায়েত উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘অবসরের পর শুনেছি, এহসান গ্রুপ ইসলামী শরিয়া অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে। এখানে টাকা রেখে লভ্যাংশ নিলে কোনো পাপ হবে না। এটা শুনে সরল বিশ্বাসে অবসরের প্রায় সব টাকাই এহসান গ্রুপে জামানত রাখি। এখন এই টাকা কীভাবে ফেরত পাব, সেই চিন্তায় আছি।’

এহসান গ্রুপে টাকা রেখে প্রতারিত হওয়া হেমায়েত উদ্দিন। তিনি এখন পিরোজপুর শহরের পিটিআই সড়কে ছেলের দোকানে বসেন

পিরোজপুর পৌরসভার খুমুরিয়া মহল্লার বাসিন্দা মো. ইব্রাহিম (৭০) বলেন, অবসর ভাতার আট লাখ টাকা এহসান গ্রুপে আমানত রেখেছিলেন। ছয় মাস লভ্যাংশ পাওয়ার পর এহসান গ্রুপ টাকা দেওয়া বন্ধ করে। অনেক ঘুরেও আমানতের টাকা ফেরত পাননি। টাকা চাইতে গেলে তাড়িয়ে দিতেন এহসান গ্রুপের কর্মীরা।

ইব্রাহিমের ছেলে মো. হাসান বলেন, ‘বাবার সব টাকা এহসান গ্রুপে আমানত রাখা। এখন একটি চাকরি করে মাসে আট হাজার টাকা বেতন পাই। সে টাকা দিয়ে পাঁচজনের সংসার চালাতে খুব কষ্ট হচ্ছে। এহসান গ্রুপে জমা রাখা টাকাটা পেলে হয়তো ব্যবসায় বিনিয়োগ করে বাড়তি আয় করা যেত। আমাদের কষ্ট কিছুটা লাঘব হতো।’

পিরোজপুর সদর উপজেলার ভৈরামপুর গ্রামের বাসিন্দা আবুল খায়ের বলেন, ‘আমি এহসান গ্রুপের কর্মী ছিলাম। আমার মাধ্যমে ১৫৬ জন ব্যক্তি এহসান গ্রুপে ৯৪ লাখ টাকা ডিপিএস ও আমানত হিসেবে জমা রাখেন। এহসান গ্রুপ টাকা ফেরত না দেওয়ায় ওই ব্যক্তিরা আমাকে টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছেন। আমি দুই বছর ধরে পালিয়ে বেড়াচ্ছি।’

বাবার বাড়ি থেকে পাওয়া জমি ও সঞ্চয়ের সব টাকা এহসান গ্রুপে রেখেছিলেন পিরোজপুর সদর উপজেলার কালীকাঠি গ্রামের মনিরা ইয়াসমীন (৪৭)। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাবার বাড়ি থেকে পাওয়া ৬১ শতাংশ জমি বিক্রির টাকা এবং বিয়ের পর থেকে জমানো ১৫ লাখ ৬৯ হাজার টাকা এহসান গ্রুপে আমানত রেখেছিলাম। দুই লাখ টাকা লভ্যাংশ পেয়েছিলাম। এর পর থেকে এহসান গ্রুপ লভ্যাংশ দেওয়া বন্ধ করে দেয়। আমানতের টাকাও ফেরত দিচ্ছে না। আমার স্বামী করোনাকালে চাকরি হারিয়েছিল। দুই বছর ধরে দুই মেয়েকে নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করেছি। বর্তমানে আমার স্বামী ঢাকায় ১০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করেন। তিনি মাসে পাঁচ হাজার টাকা পাঠান। তা–ই দিয়ে চলছি। একটু ভালো থাকার আশায় সহায়সম্বল সব এহসান গ্রুপে আমানত রেখে এখন নিঃস্ব হয়ে গেছি।’

এহসান গ্রুপের বিরুদ্ধে অভিযোগ অনুসন্ধান করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) জানতে পারে, গ্রাহকদের কাছ থেকে নেওয়া ১০১ কোটি টাকা সরিয়ে ফেলেছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধারেরা। এরপর গত বছর ২৩ ডিসেম্বর পিরোজপুর সদর থানায় অর্থ পাচার আইনে সিআইডি পরিদর্শক মীর কাশেম বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলায় রাগীব, তাঁর স্ত্রী সালমা আহসান ও চার ভাইকে আসামি করা হয়। রাগীবের স্ত্রীকে এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। ওই মামলায় গত ১৩ জুন এহসান গ্রুপের সব স্থাবর সম্পত্তি ‘ক্রোক’ করার আদেশ দেন পিরোজপুরের জেলা ও দায়রা জজ আদালত।

পিরোজপুর জেলা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি মো. আলাউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, প্রতারণা ও জালিয়াতির অভিযোগে এহসান গ্রুপের চেয়ারম্যান রাগীব আহসান ও তাঁর সহযোগীদের নামের অনুকূলে ৪০টি দলিল এবং রাগীব আহসান, তাঁর ভাই আবুল বাশার, খাইরুল ইসলাম, শামীম হাসান ও মাহমুদুল হাসান এবং রাগীবের স্ত্রী সালমা আহসানের নামে মোট পাঁচটি বিক্রয়কৃত দলিলও ক্রোকের নির্দেশ দেন আদালত। আদালতের নির্দেশে দলিলসহ ১৭৭ শতাংশ জমি ক্রোক করা হয়। ওই সম্পদের মধ্যে এহসান গ্রুপের প্রধান কার্যালয়ের বহুতল ভবন এবং শহরে শেরেবাংলা পাবলিক লাইব্রেরি ভবনে এহসান গ্রুপের দুটি দোকান রয়েছে।

অবসর ভাতার আট লাখ টাকা এহসান গ্রুপে আমানত রেখেছিলেন মো. ইব্রাহিম (৭০)। ছয় মাস লাখে দুই হাজার করে লভ্যাংশ পেয়েছিলেন। তারপর লভ্যাংশও নেই, টাকাও পান না তিনি

আমানতকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এহসান মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড, এহসান সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি লিমিটেড, ড্যাফোডিল মাল্টিপারপাস কো–অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড, এহসান বেসিক সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি লিমিটেড এবং এহসান রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড বিল্ডার্স লিমিটেড নামে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান খুলেছিল এহসান গ্রুপ। এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গ্রাহকদের কাছ থেকে নেওয়া টাকা সরিয়ে নেন রাগীব আহসান। তিনি নিজের ও আত্মীয়স্বজনের নামে পিরোজপুর শহরের কৃষ্ণনগর, খলিসাখালী, খুমুরিয়া এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় জমি কেনেন। পরে ওই সব জমির বেশির ভাগ গোপনে বিক্রি করে দেন। সাড়ে তিন বছর আগে রাগীব আহসান চেক জালিয়াতি মামলায় জড়িয়ে হাজতবাস করেন। তখন এ খবরে আতঙ্কিত ও আস্থা হারানো গ্রাহকদের মধ্যে আমানত খোয়ানোর আশঙ্কা দেখা দেয়। এ সময় আমানতকারীরা টাকা ফেরত চাইলে ২০১৯ সালের জুলাই মাস থেকে প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকদের মাসিক লভ্যাংশ ও আমানতের টাকা ফেরত দেওয়া বন্ধ করে দেয়।

পিরোজপুর পৌরসভার ব্রাহ্মণকাঠী গ্রামের বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত মাদ্রাসাশিক্ষক আলী আকবর বলেন, ‘আমার মাধ্যমে ৫৮০ ব্যক্তি এহসান গ্রুপে মোট ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা আমানত রেখেছিল। এসব আমানতকারীদের টাকা এহসান গ্রুপ ফেরত না দেওয়ায় বর্তমানে গ্রাহকেরা আমাকে নানাভাবে চাপ দিয়ে যাচ্ছেন।’

পিরোজপুর সদর উপজেলার মূলগ্রামের বাসিন্দা হারুন অর রশিদ বলেন, ‘আমি এহসান গ্রুপের মাঠ কর্মকর্তা ছিলাম। আমার মাধ্যমে ৯৭ জন ব্যক্তি ৯১ কোটি সাড়ে ১৫ লাখ টাকা এহসান গ্রুপে রাখেন। তাঁরা এখন টাকা ফেরত না পেয়ে আমাকে নানাভাবে হয়রানি করছেন।’

১০ হাজারের বেশি মানুষ এহসান গ্রুপে টাকা রেখে দুর্ভোগে পড়েছেন বলে জানান তিনি। এহসান গ্রুপের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে গ্রাহকের টাকা ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানান হারুন অর রশিদ।

পিরোজপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহেদুর রহমান বলেন, আদালতের নির্দেশে এহসান গ্রুপের বেশ কিছু সম্পদ ‘ক্রোক’ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে আদালত যেভাবে নির্দেশনা দেবেন, সেভাবে তাঁরা কাজ করবেন।