ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ২৬ ফাঁসি কার্যকর করা জল্লাদ শাহজাহান ভূঁইয়া বলেন, তিনি অতীতে যত অপরাধ করেছেন, সে জন্য সাজা খেটেছেন। কারাবাস তাঁকে পরিশুদ্ধ করেছে। তিনি আরও বলেন, প্রতিটি ফাঁসি কার্যকর করার আগে তাঁর আবেগ কাজ করেছে। তবে এ কাজ কাউকে না কাউকে করতেই হতো।
আজ রোববার দুপুর পৌনে ১২টার দিকে ৩১ বছর ৬ মাস ২ দিন কারাভোগ শেষে মুক্ত হয়ে শাহজাহান ভূঁইয়া এসব কথা বলেন। কারামুক্ত হওয়ার আগপর্যন্ত তিনি কারাগারে প্রধান জল্লাদের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। গত ২১ বছরে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে তিনি বঙ্গবন্ধুর ৬ খুনি, ৪ যুদ্ধাপরাধীসহ ২৬ জনের ফাঁসি কার্যকর করেছেন।
কারামুক্ত হওয়ার পর ঠিকানা কী হবে, সেটিও জানেন না শাহজাহান ভূঁইয়া। তিনি বলেন, ‘আমার একটিই চিন্তা—কীভাবে ভালোভাবে চলব। আমার বাড়ি নেই, ঘর নেই। আমি এখন বের হয়ে নিজের বাড়িতেও যাচ্ছি না। আমি আরেকজনের বাড়িতে গিয়ে উঠছি, যিনি একসময় আমার সঙ্গে জেলে থেকেছেন। আমি কী করে খাব জানি না। সরকারের কাছে দাবি, আমার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা তিনি করেন, আমার থাকার ব্যবস্থা করেন।’
শাহজাহান ভূঁইয়া কারামুক্ত হয়েই বলেন, ‘কারা কর্তৃপক্ষ আমাকে যথেষ্ট সম্মান দিয়েছে, আদর করেছে। আমি সেখানে (কারাগার) ভালো ছিলাম। একজন সাজাপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে কারা কর্তৃপক্ষ আমাকে জল্লাদের কাজ দিয়েছিল। আমি সাহসী ছিলাম বলেই এ কাজ পেয়েছিলাম। কাজটি আমি না করলে কেউ না কেউ করতেন। এখন আমি চলে এসেছি, এ কাজ অন্যরা করবেন।’
কোনো স্বজন আছে কি না, তা জানতে চাইলে শাহজাহান ভূঁইয়া বলেন, ‘আমার একটা বোন আছে বলে জানি। একটা ভাগনেও আছে। তবে জেলে আসার পর তাঁদের সঙ্গে আমার কখনো দেখা হয়নি। তবে দু–একবার ফোনে কথা হয়েছে।’
কারও ফাঁসি কার্যকর করতে খারাপ লেগেছে কি না, তা জানতে চাইলে শাহজাহান বলেন, ‘প্রতিটি ফাঁসির আগেই আবেগ কাজ করেছে। এখানে তো আমার কিছু করার নেই। এ কাজ (ফাঁসি) কাউকে না কাউকে তো করতে হতো। এখন আমি চলে আসছি, অন্য কেউ করবে। সাজাপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে আমাকে এ কাজ করতে হয়েছে।’
শাহজাহানের হাতে যাঁদের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে, তাঁদের মধ্যে আছেন শারমিন রীমা হত্যার আসামি মুনীর এবং খুলনার আলোচিত ব্যক্তি এরশাদ শিকদার। শাহজাহান বলেন, ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগে এরশাদ শিকদার বলেছিলেন, তিনি কোনো অন্যায় করেননি, আর মুনীর একটি সিগারেট চেয়েছিলেন।
কারা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এ পর্যন্ত ২৬ জনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন শাহজাহান। হত্যা ও অস্ত্র মামলায় তাঁর ৪২ বছরের সাজা হয়েছিল। ফাঁসি কার্যকর ও অন্যান্য কারণে তাঁর সাজার মেয়াদ কমিয়ে করা হয়েছে ৩২ বছর। তাঁর সাজার মেয়াদ আজ শেষ হলো।
শাহজাহান ভূঁইয়া যাঁদের ফাঁসি কার্যকর করেছেন, তাঁদের মধ্যে আরও আছেন বঙ্গবন্ধুর ছয় খুনি, জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লা, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, মীর কাসেম আলী, বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জেএমবির দুই জঙ্গি।
শাহজাহান ভূঁইয়ার জন্ম ১৯৫০ সালের ২৬ মার্চ নরসিংদীর পলাশ উপজেলার ইছাখালী গ্রামে। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ করে স্থানীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। নথি অনুসারে, ১৯৯২ সালের ৮ নভেম্বর ডাকাতির জন্য ১২ বছর এবং ১৯৯৫ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর অপর একটি মামলায় ডাকাতি ও হত্যার জন্য ৩০ বছরের কারাদণ্ড হয় তাঁর। এ ছাড়া উভয় রায়ে তাঁকে পাঁচ হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় করে মাস কারাদণ্ড হয়।
কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার মাহবুবুল ইসলামের তথ্যানুযায়ী, ৪২ বছরের সাজার মধ্যে প্রতি ফাঁসির জন্য দুই মাস কারা রেয়াত পেয়েছেন শাহজাহান।
কারাবিধি অনুযায়ী, আচার-আচরণ এবং অন্যান্য কারণে সব মিলিয়ে ১০ বছর ৫ মাস রেয়াত পেয়েছেন। সাজা খেটেছেন ৩১ বছর ৬ মাস ২ দিন।
শাহজাহানের হাতে কোনো টাকাপয়সা না থাকায় যে ১০ হাজার টাকা তাঁর দণ্ড হয়েছিল, তা কারা কর্তৃপক্ষ মিটিয়ে দিয়েছে।