ইতিমধ্যে ৮৭টি বাজারের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। দোকান বরাদ্দের বিধিমালা না থাকায় একটি ভবনও চালু করা যায়নি।
দ্বিতল বাজার ভবনটি প্রস্তুত। রাজবাড়ী সদর উপজেলার বসন্তপুর হাটে এই ভবন নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ২ কোটি সাড়ে ৫৮ লাখ টাকা। কিন্তু এখন নষ্ট হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে ভবনটি। বৈদ্যুতিক বাতি, বেসিন, পানির কল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মেঝেতে জমেছে পানি। গ্রামীণ অর্থনীতিতে গতি সঞ্চারের লক্ষ্যে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের দোকান বরাদ্দ দেওয়ার জন্যই ভবনটি নির্মিত হয়েছিল। কিন্তু দোকান বরাদ্দ না দেওয়ায় চালু হয়নি বাজারটি।
এই ভবনের মতোই ৮৭টি বাজারের নির্মাণকাজ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে ‘দেশব্যাপী গ্রামীণ বাজার অবকাঠামো নির্মাণ’ শীর্ষক এক প্রকল্পের আওতায়।
সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি টাকায় নির্মিত হাসপাতাল, মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের মতো অব্যবহৃত ভবনের বিষয় সামনে এসেছে। এ রকমই এই বাজার প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। হাজার কোটি টাকা খরচ করে উপজেলা পর্যায়ে বাজার ভবন করেছে সংস্থাটি। কিন্তু দোকান বরাদ্দ দিতে না পারায় ভবনগুলো অলস পড়ে নষ্ট হচ্ছে। নির্মিত ভবনগুলোর দোকানের শাটার, টাইলস, মেঝেতেও দৃশ্যমান ত্রুটি দেখা যাচ্ছে। পড়ে থাকায় একদিকে ভবনের ক্ষতি হচ্ছে, অন্যদিকে প্রকল্পের মূল্য উদ্দেশ্যও পূরণ হচ্ছে না। প্রতিবছর রাজস্ববঞ্চিত হচ্ছে সরকার।
এলজিইডি সূত্রে জানা যায়, দেশের ৬৪ জেলার সব উপজেলা এলাকায় মোট ৫০৭টি বাজার ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রকল্পটির মোট ব্যয় ১ হাজার ৬৯১ কোটি টাকা। প্রতিটি বাজার নির্মাণে ব্যয় হয়েছে আড়াই থেকে তিন কোটি টাকার মতো। কিন্তু দোকান বরাদ্দের বিধিমালা জটিলতায় একটি ভবনও চালু করা যায়নি।
প্রকল্পটির উদ্দেশ্য সম্পর্কে এর ডিপিপি বা উন্নয়ন প্রস্তাবে বলা হয়েছে, গ্রামীণ বাজার উন্নয়নের মাধ্যমে কৃষি ও অকৃষি পণ্য বাজারজাতের সুবিধা বাড়ানো, গ্রামপর্যায়ে ব্যবসার পরিবেশ সৃষ্টি এবং স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মসংস্থান সৃষ্টি। গ্রামীণ অর্থনীতিতে প্রাণ সঞ্চারের উদ্দেশ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, প্রকল্প শুরুর পর ছয় বছরেও দোকান বরাদ্দের নীতিমালা না করতে পারা এলজিইডির সংশ্লিষ্টদের অদূরদর্শিতার প্রমাণ।
এই ভবনের মতোই ৮৭টি বাজারের নির্মাণকাজ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে ‘দেশব্যাপী গ্রামীণ বাজার অবকাঠামো নির্মাণ’ শীর্ষক এক প্রকল্পের আওতায়।
৬ আগস্ট সরেজমিনে রাজবাড়ী সদরের বসন্তপুর হাট, সিলেট সদরের শাহজালাল বাজার, শেরপুর সদরের ভীমগঞ্জ বাজার এবং মেহেরপুরের মুজিবনগরের কেদারগঞ্জ হাটের নির্মিত ভবন সরেজমিন পরিদর্শন করেন প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা। দেখা যায়, এসব ভবন অব্যবহৃত পড়ে আছে। এসব বাজারে দোকান বরাদ্দ পাওয়ার বিষয়ে স্থানীয় লোকজনের মধ্যে বেশ আগ্রহ রয়েছে। প্রতিটি বাজারেই চারতলার ফাউন্ডেশন দিয়ে দোতলা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।
রাজবাড়ী সদর উপজেলার হাটজয়পুর গ্রামে বসন্তপুর হাটের মাঝখানে দ্বিতল বাজার ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। বসন্তপুর হাট ব্যবসায়ী পরিচালনা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘দোকানগুলো বরাদ্দ দিলে ভালো হতো। বিশেষ করে মার্কেটের নিচে সবজি, মাছ, মাংসের খোলা দোকান বসার কথা। এখন এসব দোকান রাস্তার পাশে বসে। রোদ-বৃষ্টিতে ভোগান্তি পোহাতে হয়। দোকান বরাদ্দের বিষয়ে স্থানীয় ভূমি অফিসে আমরা কয়েকবার গিয়েছি। কিন্তু কাজ হয়নি।’
মেহেরপুরের মুজিবনগরের বাগোয়ান ইউনিয়নে কেদারগঞ্জ হাটটি অবস্থিত। কেদারগঞ্জ হাটে দোতলা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। দোতলায় মোট ১৩টি দোকান রয়েছে। দেড় বছরের বেশি সময় ধরে দোকানগুলো তালাবদ্ধ।
এই প্রকল্পের একটি নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদন তৈরি করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। নির্মাণ শেষ হওয়া কয়েকটি বাজার পরিদর্শন করে বেশ কিছু ত্রুটি পেয়েছে আইএমইডি। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, সিলেটের শাহজালাল বাজারে কিছু ফাটল দেখা গেছে। কুমিল্লার মেঘনা উপজেলার রামপুর বাজারেও ফাটল রয়েছে। বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলার তালুছ বাজারে নিচতলার নির্মাণকাজ যথাযথ হয়নি। ভোলার লালমোহন উপজেলার কর্তারহাট বাজারে নির্মাণাধীন ভবনে বৈদ্যুতিক লাইনে নিম্নমানের পাইপ ও কেব্ল ব্যবহার করা হয়েছে। শৌচাগারের দরজা ও টাইলস নিম্নমানের। ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার উত্তর ইছাবাজারে দেয়ালের প্লাস্টার নষ্ট হয়ে গেছে। বাজারগুলোর বেসিন ও শৌচাগারগুলো দীর্ঘদিন অপরিষ্কার থাকায় ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
দোকানগুলো বরাদ্দ দিলে ভালো হতো। বিশেষ করে মার্কেটের নিচে সবজি, মাছ, মাংসের খোলা দোকান বসার কথা। এখন এসব দোকান রাস্তার পাশে বসে। রোদ-বৃষ্টিতে ভোগান্তি পোহাতে হয়। দোকান বরাদ্দের বিষয়ে স্থানীয় ভূমি অফিসে আমরা কয়েকবার গিয়েছি। কিন্তু কাজ হয়নি।বসন্তপুর হাট ব্যবসায়ী পরিচালনা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মোজাম্মেল হক
গ্রামীণ বাজার অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পটির কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালের জুলাইয়ে। মেয়াদ ছিল ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে কাজের অগ্রগতি হয়নি। তিন দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে এখন তা ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত। তবে ছয় বছর পেরোলেও প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি ৫০ শতাংশের মতো। প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি আরও কম। ফলে বর্ধিত সময়েও কাজ শেষ হবে না বলে মনে করা হচ্ছে।
প্রকল্প–সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বাজারের নকশা প্রণয়ন, বাজার ভবন নির্মাণের অনুমতি পেতে বিলম্ব, মামলাসংক্রান্ত জটিলতা, ভূমিপ্রাপ্তি ও নির্মাণকাজ শেষে হস্তান্তর জটিলতার কারণে প্রকল্পে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হয়েছে। এখনো অনেক উপজেলায় বাজার নির্মাণের জন্য জায়গা নির্বাচন ও খালি করা সম্ভব হয়নি। আবার নির্মাণ শেষ হলেও নির্মিত ভবনগুলো জেলা প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় দেরি হচ্ছে।
প্রকল্পের আওতায় ৫০৭টি বাজার নির্মাণ করার কথা। এর মধ্যে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত ১৯১টি বাজারের নির্মাণকাজ চলমান ছিল। ৮৭টি বাজারের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। এর মধ্যে ২৮টি জেলা প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করা গেছে। মামলাসহ বিভিন্ন জটিলতার কারণে প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত ৭৭টি বাজার নির্মাণ করাই সম্ভব হচ্ছে না।
আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়, বেশ কিছু স্থানে বাজারের অবকাঠামো নির্মাণের মতো ভূমি না থাকার পরও ওই স্থানকে অবকাঠামো নির্মাণের জন্য নির্বাচন করা হয়েছে। প্রকল্প নেওয়ার আগে প্রাক্–সম্ভাব্যতা যাচাই হলে স্থানসংক্রান্ত এসব জটিলতা হতো না। প্রকল্প শুরুর আগে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে পরামর্শ করা হলে নির্মিত ভবন হস্তান্তরে সমস্যা কম হতো।
এ বিষয়ে প্রকল্পের পরিচালক স্বপন কান্তি পাল প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে ঘাটতি ছিল। মামলার কারণেও কিছু বাজার নির্মাণ করা যাচ্ছে না। এর পরিবর্তে এই প্রকল্পের অর্থ দিয়েই যেখানে বাজারের চাহিদা রয়েছে, সেখানে ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
ছয় বছরেও দোকান বরাদ্দের নীতিমালা না করতে পারা এলজিইডির সংশ্লিষ্টদের অদূরদর্শিতার প্রমাণ। জনগণের টাকায় নির্মিত স্থাপনা এভাবে ফেলে রাখার বিষয়ে তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।আইপিডি নির্বাহী পরিচালক আদিল মুহাম্মদ খান
প্রকল্পের ছয় বছর পার হলেও কীভাবে বাজারের দোকান বরাদ্দ দেওয়া হবে, সে বিষয়ে কোনো বিধিমালা হয়নি। তবে প্রকল্প–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, দোকান বরাদ্দ দেওয়ার জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে একটি পরিপত্র প্রস্তুত করা হয়েছিল। এটি অনুমোদনের জন্য ২০২২ সালের মার্চ মাসে পরিপত্রটি ভূমি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।
এর পরিপ্রেক্ষিতে ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে ২০২২ সালের জুনে স্থানীয় সরকার বিভাগে চিঠি দেওয়া হয়। তাতে বলা হয়, হাট ও বাজার স্থাপন, উন্নয়ন, ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়াধীন। আইন পাস হলেই বিধিমালা প্রণয়ন করা হবে। নতুন বিধিমালা প্রণয়নের আগে এ–সংক্রান্ত কোনো পরিপত্র জারি না করার বিষয়ে চিঠিতে বলা হয়।
প্রকল্পের পরিচালক স্বপন কান্তি পাল প্রথম আলোকে বলেন, জাতীয় সংসদে পাস হওয়ার পর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে হাটবাজার (স্থাপন ও ব্যবস্থাপনা) আইনের গেজেট প্রকাশিত হয়েছে। এই আইনের অধীনে দোকান বরাদ্দের বিধিমালা প্রণয়নের কাজ চলছে। বিধিমালা হওয়ার পরেই দোকান বরাদ্দের কার্যক্রম শুরু করা যাবে।
গ্রামীণ অর্থনীতিতে প্রাণসঞ্চারের জন্য নির্মিত ভবন অব্যবহৃত পড়ে থাকার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে গবেষণা ও নীতি বিশ্লেষণী প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক আদিল মুহাম্মদ খান প্রথম আলোকে বলেন, নির্মাণের সঙ্গে টাকার সংশ্লেষ থাকায় সরকারি সংস্থাগুলো এই কাজে বেশি আগ্রহী। কিন্তু নির্মিত ভবনের ব্যবহার, রক্ষণাবেক্ষণের মতো বিষয়ে সার্বিক পরিকল্পনার অভাব থাকে। ছয় বছরেও দোকান বরাদ্দের নীতিমালা না করতে পারা এলজিইডির সংশ্লিষ্টদের অদূরদর্শিতার প্রমাণ। জনগণের টাকায় নির্মিত স্থাপনা এভাবে ফেলে রাখার বিষয়ে তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।
[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন এজাজ আহম্মেদ, রাজবাড়ী ও আবু সাঈদ, মেহেরপুর]