মানসম্পন্ন কারিগরি শিক্ষা বাংলাদেশের আগামী দিনের রূপান্তরের চালিকা শক্তি বলে মন্তব্য করেছেন এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক ও সিপিডির সম্মানিত ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, এ শক্তি শিল্পায়ন, কৃষি ও সেবা খাতের আধুনিকায়ন—সবগুলোর জন্য প্রয়োজন। আজ শনিবার সকালে জাতীয় যুব সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।
‘যুব কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে স্থানীয় কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা’ শীর্ষক এ সম্মেলনের আয়োজন করে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
সম্মেলনে সভাপতির বক্তব্যে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, উন্নয়নের পরবর্তী ধাপে যেতে হলে, উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ হতে হলে, এসডিজি বাস্তবায়ন করতে হলে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে মসৃণভাবে বেরোতে হলে শিক্ষা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর মধ্যে মানসম্পন্ন শিক্ষা হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর মানসম্পন্ন কারিগরি শিক্ষা হচ্ছে বাংলাদেশের আগামী দিনের রূপান্তরের অন্যতম চালিকা শক্তি। এ শক্তি শিল্পায়ন, কৃষি ও সেবা খাতের আধুনিকায়ন—সবগুলোর জন্য প্রয়োজন।
অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘বর্তমানে বহু ধরনের সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে।...কারিগরি শিক্ষার আধুনিকায়ন এবং এর সংস্কার নয়, রূপান্তরের জন্য একটি অংশীদারত্বমূলক বিশেষজ্ঞ কমিটি তৈরি করতে সরকারের কাছে আহ্বান জানাচ্ছি।’ তিনি আশা করেন, অন্তর্বর্তী সরকার খুব দ্রুততার সঙ্গে আধুনিক, দক্ষ ও সময়োপযোগী বিশ্বমানের কারিগরি বৃত্তিমূলক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে, সেটা কীভাবে করা যায়, তার একটি রূপান্তরমূলক কর্মপরিকল্পনার জন্য দ্রুত কমিটি করবে।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এর উপকার যেন বাংলাশের পিছিয়ে পড়া মানুষ পায়। যারা সাম্পতিক গণ–আন্দোলনে আহত হয়েছেন, পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন, বিভিন্নভাবে অসুবিধাগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁরা যেন রূপান্তরমূলক প্রশিক্ষণের সুযোগে নিজেদের জীবনকে নতুনভাবে দাঁড় করাতে পারেন।
এ ছাড়া বস্তিবাসী, দলিত শ্রেণির পিছিয়ে পড়া মানুষ, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ, প্রতিবন্ধী এবং আদিবাসী দুর্গম অঞ্চলের মানুষ যাতে সুযোগ পায়—সে কথাও উল্লেখ করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, সর্বোপরি নারীরা যাতে প্রধান হিসেবে আসেন। এ মানুষদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। নতুন দেশের নতুন সুযোগে তরুণেরা নেতৃত্ব দিয়ে এ কাজগুলো এগিয়ে নেবেন।
সম্মেলনে নিরীক্ষা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সিপিডির জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান। প্রতিবেদনে বলা হয়, মধ্যবিত্ত শ্রেণি এখনো কারিগরি শিক্ষাকে ‘মিস্ত্রি’ তৈরির শিক্ষা হিসেবে মনে করে। সাধারণ মানুষ তাদের ঘৃণার চোখে দেখে বলেও শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন। তাই সামাজিকভাবে কারিগরি শিক্ষা ও কর্মসংস্থান সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা তৈরি করতে হবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের কারিগরি শিক্ষায় প্রদত্ত সনদ কোনো আন্তর্জাতিক প্রত্যয়নকারী সংস্থার মান পূরণ করে না। তাই অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক বাজারের চাহিদার সঙ্গে পাঠ্যক্রম ও পাঠদান প্রক্রিয়ার সামঞ্জস্য আনতে হবে। তবে এই কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমেই দেশে বেকারত্বের হার ২০১০ সালে যেখানে ছিল ৭ শতাংশ, ২০২২ সালে তা ৩ দশমিক ৯ শতাংশে নেমে এসেছে।
দেশের পঞ্চগড়, সুনামগঞ্জ ও সাতক্ষীরা অঞ্চলে এই সামাজিক নিরীক্ষা চালানো হয়েছে। এতে কারিগরি প্রতিষ্ঠানের ৬০০ জন প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থী, ৬০ জন শিক্ষক-প্রশিক্ষক ও প্রশাসক, ২৪০ জন অভিভাবক, বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ১৫টি আলোচনা সভা এবং ৭৫ জন সরকারি কর্মকর্তা, বিষেশজ্ঞ ও চাকরিদাতার সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। নিরীক্ষা চলতি বছরের মার্চ-এপ্রিলে করা হয়।
সম্মেলনে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ও ইউসেপ বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারপারসন আবদুল মতিন চৌধুরী বলেন, দেশে ও দেশের বাইরে দারুণ সম্ভাবনা রয়েছে। প্রয়োজন শুধু মানসিকতার পরিবর্তন। তাহলেই সমস্যাগুলো বিনা খরচে সম্পূর্ণ সমাধান সম্ভব। এর জন্য তিনি কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ক্ষেত্রে কারখানার মালিকদের দায়িত্ব নেওয়ারও আহ্বান জানান।
সরকারি কারিগরি প্রতিষ্ঠানগুলোতে ৮০ ভাগ পদ খালি পড়ে আছে উল্লেখ করে আবদুল মতিন চৌধুরী বলেন, কোনো লোক নিয়োগ দেওয়া যাচ্ছে না বা হচ্ছে না। অর্থাৎ এটা কাজই করছে না। ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে বেসরকারি সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের হাতে দিয়ে দেওয়া হোক। তারা সেটা সুন্দরভাবে চালাতে পারবে।
প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব রুহুল আমিন বলেন, যাঁরা প্রশিক্ষণ নিতে চান কিংবা যাঁরা প্রশিক্ষণ দেবেন, তাঁদের প্রত্যেকের আগ্রহ থাকতে হবে। অনেক কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে শিক্ষার্থী পাওয়া যায় না।
কর্মী হিসেবে বিদেশে যাওয়ার খরচের বিষয়ে তিনি বলেন, মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্মের কারণে কর্মী যাওয়ার ব্যয় বাড়ছে। এ বিষয়ে একটি আইনি কাঠামোর মধ্যে আনার চেষ্টা চলছে। বিধিমালা তৈরি করা হয়েছে।
সরকারি কারিগরি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক ও প্রশিক্ষক–সংকটের বিষয়ে সিপিডির ডিস্টিংগুইশড ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, যদি মাত্র ১৮ ভাগ শিক্ষক বা প্রশিক্ষক থাকেন, তাহলে নতুন নতুন প্রতিষ্ঠানগুলো কাদের দিয়ে পরিচালনা করবেন?
সম্মেলনে সূচনা বক্তব্য দেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) যুগ্ম পরিচালক অভ্র ভট্টাচার্য। এতে অন্যদের মধ্যে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান রাকিব উল্লাহ, কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক মাকসুদুর রহমান, বাংলাদেশ ফেডারেশন অব ওমেন এন্ট্রাপ্রেনার্সের সভাপতি রুবিনা হোসেন, বাংলাদেশ এপারেল ইয়ুথ লিডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবরার হোসেন, বিকাশ লিমিটেডের সহসভাপতি নোভেরা আয়েশা জামান, ইকো-সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (ইএসডিও) প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক শহীদ-উজ-জামান এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের প্রকল্প ব্যবস্থাপক মার্গা পিটার্স কারিগরি শিক্ষা, সমস্যা ও সম্ভাবনার নানা বিষয়ে আলোচনা করেন।
সম্মেলনে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী এবং পঞ্চগড়, সুনামগঞ্জ ও সাতক্ষীরা অঞ্চলের বিভিন্ন কারিগরি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা অংশ নেন।