করোনা বিধিনিষেধের সময়ে সবচেয়ে গরিব এলাকা ছিল কুড়িগ্রাম জেলা। কিন্তু ওই জেলায় ত্রাণসহায়তা গেছে কম। আর নারায়ণগঞ্জ ছিল সবচেয়ে ধনী এলাকা। তবে সহায়তা গেছে এই জেলায় বেশি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই অসংগতির বিষয়টি নিয়ে পোস্ট দিয়েছিলেন সফটওয়্যার প্রকৌশলী দিদারুল ভুইয়া। এ কারণে প্রথমে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। চোখে কালো কাপড় বেঁধে প্রায় সাত ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করার পর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দেওয়া হয়। ওই মামলায় পাঁচ মাস কারাগারে কাটাতে হয়েছে তাঁকে।
আজ মঙ্গলবার দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আয়োজিত এক মানববন্ধনে অংশ নিয়ে এসব কথা বলেন দিদারুল। প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান ও সাংবাদিক শামসুজ্জামান এবং যুগান্তরের বিশেষ প্রতিনিধি মাহবুব আলমের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে (ডিএসএ) মামলা এবং র্যাব হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর প্রতিবাদে এই কর্মসূচির আয়োজন করে ডিএসএ ভিক্টিমস নেটওয়ার্ক নামের একটি সংগঠন।
মানববন্ধনে দিদারুল ভুইয়াসহ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ভুক্তভোগী পাঁচ ব্যক্তি অংশ নেন। বক্তব্যে দিদারুল ভুইয়া আরও বলেন, লেখক মোশতাক আহমেদ তাঁর বন্ধু ছিলেন। একই মামলায় তাঁরা জেলে ছিলেন। এর মধ্যে মোশতাকের ভাগ্য হয়নি জান নিয়ে জেল থেকে বের হওয়ার। তাঁর সেই ভাগ্য হয়েছে জান নিয়ে জেল থেকে বের হওয়ার।
মামলার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে দিদারুল বলেন, করোনার সময় তিনি ‘দুর্যোগ সহায়তা মনিটরিং কমিটি’ নামের একটা কমিটির সঙ্গে কাজ করতেন। ওই কমিটির একটা প্রতিবেদন ছিল, ‘সরকারের খানা জরিপে কুড়িগ্রাম জেলা সবচেয়ে গরিব এলাকা। সেখানে সরকারের যে ত্রাণসহায়তা, তা গেছে সবচেয়ে কম। আর নারায়ণগঞ্জ, যেটা খানা জরিপে সবচেয়ে ধনী একটা এলাকা। সেখানে সাহায্য গেছে সবচেয়ে বেশি। এই অসংগতি দুর্যোগ সহায়তা মনিটরিং কমিটি থেকে তুলে ধরি। বিষয়টি নিয়ে সোচ্চার ছিলাম। এ কারণেই আমাকে তুলে নেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে ডিএসএ আইনে মামলা দেওয়া হয়। পাঁচ মাস জেল খেটেছি। সেই মামলা এখনো আছে।’
একই অনুষ্ঠানে ভৈরব থেকে আগত ইমতিয়াজ কাজল নামের এক ব্যক্তি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা মামলায় তিনি ১০ মাস কারাগারে ছিলেন। ভোট দিতে না পেরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দেওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।
আর ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা এন ইউ আহমদ মানববন্ধন কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে বলেন, তিনি প্রায় পাঁচ বছর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের একটি মামলার ঘানি টানতে গিয়ে হাজার হাজার টাকা খরচ করে অনেক ক্ষতিতে পড়েছেন। আদালতে প্রমাণিত হয়েছে তাঁর অপরাধ হয়নি। ওই মামলায় বেকসুর খালাস পেয়েছেন।
‘কিন্তু সরকার এই আইনের মাধ্যমে যে আমাকে পাঁচ বছর নির্যাতন করল, ১১ মাস জেলে কারা নির্যাতন করল, পারিবারিক ও আর্থিক ক্ষতি করল, আমার পড়ালেখার ক্ষতি করল—এর দায়ভার বা ক্ষতিপূরণ কে দেবে?’—এই প্রশ্ন তোলেন তিনি। এন ইউ আহমদ ফেসবুক পোস্টে বলেছিলেন, ভোটের অধিকার নাই, ভোট দিতে পারেননি।
মানববন্ধনের আয়োজক সংগঠন ডিএসএ ভিক্টিমস নেটওয়ার্কের আহ্বায়ক গোলাম মাহফুজ জোয়ার্দারও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের একটি মামলায় সাড়ে ১০ মাস কারাগারে ছিলেন। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার কারণে তাঁকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিশাল বহর এসে বাসা থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল বলে দাবি করেন তিনি।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অবিলম্বে নিষিদ্ধের দাবি জানিয়ে গোলাম মাহফুজ জোয়ার্দার বলেন, যাঁরা এই আইনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁদের প্রত্যেককে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হোক। এই আইন সংবিধানবিরোধী বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
মানববন্ধন কর্মসূচিতে বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ সংহতি জানিয়ে বক্তব্য দেন। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুলও ছিলেন। তিনি বলেন, এটা বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে জঘন্য একটা আইন। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট করা হয়েছে যারা অত্যাচার করে, নির্যাতন করে, শোষণ করে, দুর্নীতি করে—সেই শাসকশ্রেণিকে রক্ষার করার জন্য। এই আইন করা হয়েছে গুম করার জন্য, গুমকে নির্বিঘ্ন করার জন্য। ভোটাধিকার হরণকে নির্বিঘ্ন করার জন্য। রাষ্ট্রীয় সম্পদ পাচারকে নির্বিঘ্ন করার জন্য। দেশের স্বার্থ বিদেশের কাছে বিকিয়ে দেওয়াকে নির্বিঘ্ন করার জন্য।
এই আইন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী দাবি করে অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, এটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। যারা ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের পক্ষে বলে এবং যারা ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের ভিকটিমদের বিপক্ষে বলে, তারাও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপক্ষের শক্তি।
আসিফ নজরুলের ভাষ্য, ‘প্রথম আলোর পক্ষ থেকে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছিল, সেখানে মূল কথা হচ্ছে দ্রব্যমূল্য। মূল কথা হচ্ছে মানুষের ভাতের অধিকারে কষ্ট হচ্ছে, মানুষের জীবিকার অধিকারে কষ্ট হচ্ছে। এটা কি কেউ অস্বীকার করতে পারে? আমরা সবাই বাজারে যাই। আমরা জানি দ্রব্যমূল্য কী পরিমাণ বেড়েছে। আমরা জানি কিছু লোকের হাতে সব টাকা কুক্ষিগত হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার বেড়েছে। বৈষম্যের হার বেড়েছে, মানুষের কষ্ট বেড়েছে—এ রকম একটা প্রতিবেদন বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে আজকে যারা ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের সুযোগ করে দিয়েছে, তারাই স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি। তারাই স্বাধীনতাকে হেয় করেছে।’
ডিজটাল নিরাপত্তা আইন কেবল বাতিল নয়, যারা এই আইন প্রণয়ন করেছে এবং এর অপপ্রয়োগ করেছে, তাদের প্রত্যেকের শাস্তির ব্যবস্থা করার দাবি করেন আসিফ নজরুল।
মানববন্ধনে সংহতি জানান গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি। তিনি অভিযোগ করেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তাদের শাসন চিরস্থায়ী করতে চাইছে।
মানববন্ধনে আরও বক্তব্য দেন রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুম, ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি মশিউর রহমান প্রমুখ।