বাজার পরিস্থিতি

দ্রব্যমূল্য বেড়েছে আরেক দফা

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর প্রায় সব নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। সরকারি হিসাবেই উঠে আসছে মূল্যবৃদ্ধির চিত্র।

কাঁচাবাজার থেকে একটি পরিবারে যা যা কিনতে হয়, তার প্রায় সবকিছুর দামই আরেক দফা বেড়েছে। এ তালিকায় যেমন চাল, ডাল, তেল, চিনি, আটা আছে, তেমনি রয়েছে সবজি, ডিম ও মুরগির দাম। পিছিয়ে নেই মাছ ব্যবসায়ীরাও। তাঁরাও দাম বাড়িয়েছেন।

এই মূল্যবৃদ্ধি সেসব সীমিত আয়ের মানুষের ওপর নতুন আঘাত, যাঁরা ইতিমধ্যে মূল্যস্ফীতিতে নাকাল। এর আগে মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করা হয়েছিল। এবার ব্যবসায়ীরা সামনে আনছেন ট্রাকভাড়া বেড়ে যাওয়া এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধিকে। তাঁরা বলছেন, জ্বালানি তেলের দাম রেকর্ড পরিমাণ বাড়ানোর প্রভাব কাঁচাবাজারে পড়েছে। আগামী দিনগুলোয় শিল্পপণ্যের দামেও প্রভাব পড়তে পারে।

দাম কতটা বেড়েছে, তা দেখা যায় সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজারদরের তালিকায়ই। টিসিবি প্রতিদিন ঢাকার নয়টি বাজার থেকে নিত্যপণ্যের দাম সংগ্রহ করার পর প্রতিবেদন তৈরি করে তা মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগে পাঠায়। সংস্থাটির প্রতিবেদন বলছে, ৪ আগস্ট থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দাম বেড়েছে সব ধরনের চাল, ডাল, আটা, ময়দা, বোতলজাত সয়াবিন তেল, চিনি, রসুন, দেশি পেঁয়াজ, শুকনা মরিচ, আদা, ডিম ও ব্রয়লার মুরগির। কমেছে শুধু খোলা সয়াবিন তেল ও হলুদের দাম।

সবজির দামের হিসাবটি টিসিবির তালিকায় নেই। তবে ঢাকার মহাখালী, মালিবাগ, মগবাজার, মিরপুর ১ নম্বর সেকশনের কাঁচাবাজার ও কারওয়ান বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বেশির ভাগ সবজি প্রতি কেজি ৫০ থেকে ৭০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এই দর এক সপ্তাহ আগের তুলনায় কেজিপ্রতি গড়ে ১০ টাকা বেশি। কাঁচা মরিচের কেজি ছাড়িয়েছে ২৫০ টাকা। ব্যবসায়ীরা মাছের দাম গড়ে ২০ টাকা বেশি চাইছেন।

মূল্যবৃদ্ধির হার কেমন, তা দেখা যাক চালের ক্ষেত্রে। টিসিবি বলছে, মোটা চাল ২ টাকা এবং মাঝারি ও সরু চাল প্রতি কেজি ৩ টাকা করে বেড়েছে। বাজারে এখন আর ৫০ টাকা কেজির নিচে চাল নেই। মাঝারি চাল প্রতি কেজি ৫৩ থেকে ৫৮ টাকা এবং সরু চাল ৬৫ থেকে ৭৮ টাকায় কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের।

এক সপ্তাহের চিত্রে চালের বাজারের পরিস্থিতি পুরোটা উঠে আসে না। টিসিবির হিসাবে, ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি বাজারে প্রতি কেজি মোটা চালের সর্বনিম্ন দাম ছিল ৩০ টাকা। সেই হিসাবে এখন দাম প্রায় ৬৭ শতাংশ বেশি।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গত বুধবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে সব জিনিসেরই দাম বেড়ে যায়। এতে গরিব মানুষের ওপর প্রভাব পড়ে এবং মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যায়। এটা স্বাভাবিক। তবে সরকার বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষকে স্বস্তি দিতে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

নতুন কারণ ট্রাকভাড়া

বাজারে একসঙ্গে মূল্যবৃদ্ধি শুরু হয়েছিল ২০২০ সালের শুরুর দিকে। ওই বছর ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনার রোগী শনাক্তের ঘোষণা দেওয়া হয়। এরপর ‘লকডাউনের’ আশঙ্কায় বাজারে শুরু হয় আতঙ্কের কেনাকাটা। বেড়ে যায় চাল, ডাল, তেল, চিনিসহ নিত্যপণ্যের দাম। ২০২১ সালের মাঝামাঝি থেকে করোনা পরিস্থিতির উন্নতির পর চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বাড়তে থাকে। যার প্রভাব পড়ে দেশেও। সর্বশেষ গত ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু এবং মে মাস থেকে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় খাদ্যপণ্যের দাম যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে সাবান, শ্যাম্পু, টুথপেস্ট, টিস্যু, কাগজ–কলম, খাতাসহ প্রায় সব পণ্যের দাম।

এতে গত জুন মাসে দেশে মূল্যস্ফীতির হার ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে ওঠে। জুলাই থেকে নিত্যপণ্যের দাম কিছু কিছু কমছিল। যেমন সয়াবিন তেলের দাম দুই দফায় লিটারপ্রতি ২০ টাকা কমানো হয়। সব মিলিয়ে জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে। কিন্তু সেই স্বস্তিটুকু দূর করে দিয়েছে সরকারের জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত।

জ্বালানি মন্ত্রণালয় ৫ আগস্ট রাতে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারপ্রতি ৩৪ টাকা বাড়িয়ে ১১৪ টাকা, পেট্রলের দাম ৪৪ টাকা বাড়িয়ে ১৩০ টাকা ও অকটেনের দাম ৪৬ টাকা বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা নির্ধারণ করে। এরপরই বেড়েছে বাস ও ট্রাকভাড়া।

জিনিসপত্রের দাম এতটা বেড়েছে যে এই বেতনে পরিবার নিয়ে ঢাকায় থাকা সম্ভব নয়। তাই পরিবার বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে মেসে উঠেছি।
মো. রুবেল, বেসরকারি চাকরিজীবী

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার আগের দিনের (৪ আগস্ট) সঙ্গে টিসিবির গতকালের বাজারদরের তালিকার তুলনা করলে দেখা যায়, খোলা আটা ও ময়দা কেজিতে তিন টাকা, বোতলজাত সয়াবিন লিটারে ৫ টাকা, চিনি ২ টাকা, মোটা দানার মসুর ডাল কেজিপ্রতি ১০ টাকা, দেশি রসুন ১০ টাকা, ব্রয়লার মুরগি ২০ টাকা ও ডিম হালিতে ১৩ টাকা বেড়েছে।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা গেছে, টিসিবির তালিকায় উল্লিখিত দরের চেয়ে বাজারে পণ্যের দাম বেশি। পাঁচটি বাজার ঘুরে কোথাও ৫০ টাকা কেজিতে চাল পাওয়া যায়নি। মোটা চাল আসলে বিক্রি হচ্ছে ৫২ থেকে ৫৩ টাকা কেজি দরে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, সব পণ্যের দামের সঙ্গেই ট্রাকভাড়া যুক্ত। জ্বালানির দাম বাড়ার পর ট্রাকভাড়া ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বেড়েছে। এর সঙ্গে পণ্যভেদে নানা কারণও রয়েছে, যা দাম বাড়িয়েছে।

বাজারে এখন চড়া দামের দুটি পণ্য ডিম ও মুরগির উদাহরণ দেওয়া যাক। মুদিদোকানে ফার্মের মুরগির প্রতি হালি ডিম ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে, যা সাধারণত ৩২ টাকার আশপাশে থাকে। ব্রয়লার মুরগি বাজারভেদে বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ১৮০ থেকে ২০০ টাকা দরে, যা সাধারণত ১৫০ টাকার নিচে থাকে।

মুরগি ও ডিমের দামের বিষয়ে পোলট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক খন্দকার মো. মহসিন প্রথম আলোকে বলেন, ডলারের মূল্য ও রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ভুট্টার সরবরাহ কমে যাওয়া এবং জাহাজভাড়ার কারণে মুরগির খাবারের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। ডিম–মুরগির উৎপাদনও কম। নতুন করে যুক্ত হয়েছে ট্রাকভাড়ার বাড়তি ব্যয়।

চালের বাড়তি দামের ক্ষেত্রেও ব্যবসায়ীরা যেমন ধানের বাড়তি দরকে দায়ী করছেন, তেমনি দায়ী করছেন ট্রাকভাড়াকে। বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিলমালিক সমিতির কুষ্টিয়া শাখার সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন প্রধান প্রথম আলোকে বলেন, ধানের দাম মণপ্রতি দেড় শ টাকা বেড়েছে। ডিজেলের দাম বাড়ায় ধান মিলে আনতে ট্রাকপ্রতি ২ হাজার টাকা বাড়তি ব্যয় হচ্ছে।

উল্লেখ্য, কুষ্টিয়া ও নওগাঁয় গত এক সপ্তাহে চালের দাম কেজিপ্রতি ২ থেকে ৪ টাকা বেড়েছে।

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে ট্রাকভাড়া যতটুকু বাড়ার কথা, বৃদ্ধির পরিমাণ তার চেয়ে বেশি। ঢাকা–চট্টগ্রাম রুটের উদাহরণ দেওয়া যাক। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সড়কপথে ঢাকার নারায়ণগঞ্জ–গাজীপুরে যেতে ছয় চাকার পণ্যবাহী (ট্রাক–কাভার্ড ভ্যান) যানবাহনে ডিজেল দরকার হয় ৬০ থেকে ৭০ লিটার। ডিজেলের দাম বাড়ানোর কারণে ব্যয় বেড়েছে ২ হাজার ৪০ টাকা থেকে ২ হাজার ৩৮০ টাকা। যদিও পরিবহন কোম্পানিগুলো ভাড়া বাড়িয়েছে প্রায় চার হাজার টাকা।

মূল্যবৃদ্ধির এখানেই ‘শেষ নয়’

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, জ্বালানি তেলের দামের কারণে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এখানেই শেষ নয়। দাম আরও বাড়ার আশঙ্কা আছে। দুটি কারণে দাম আরও বাড়তে পারে—১. পণ্য সরবরাহকারী করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো আগামী দিনগুলোয় ভাড়া বাবদ বাড়তি ব্যয় সমন্বয় করে তাদের পণ্যের নতুন দাম নির্ধারণ করবে। ২. কৃষিপণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়বে, যা দাম আরও বাড়িয়ে দেবে।

যেমন ভোজ্যতেল বিপণনকারী কোম্পানিগুলো ৩ আগস্ট সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ২০ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। এরপর জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে। সূত্র জানিয়েছে, তারা এখন ট্রাকভাড়া বাবদ ব্যয়ও সমন্বয় চায়।

‘স্ত্রীকে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছি’

নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় সীমিত আয়ের মানুষ সংকটে পড়েছেন। তাঁরা নানাভাবে ব্যয় কমিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন। বেসরকারি চাকরিজীবী মো. রুবেল নিজের আয় দিয়ে আর চলতে পারছিলেন না। এ কারণে স্ত্রীকে গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে নিজে উঠেছেন মেসে। তিনি একটি কোম্পানিতে বিক্রয়কর্মীর কাজ করে মাসে ১৮ হাজার টাকা বেতন পান। বাসাভাড়া, পরিবহন খরচ ও খাবার ব্যয় সেই টাকা দিয়ে মেটানো যাচ্ছিল না। আবার গ্রামে বাবা–মাকেও কিছু টাকা দিতে হয়।

রুবেল বলেন, ‘একটা মানুষ কত কষ্টে থাকলে স্ত্রীকে বাড়িতে রেখে আসার মতো সিদ্ধান্ত নেয়, সেটা বোঝানো সম্ভব না। জিনিসপত্রের দাম এতটা বেড়েছে যে এই বেতনে পরিবার নিয়ে ঢাকায় থাকা সম্ভব নয়। তাই পরিবার বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে মেসে উঠেছি।’

[প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা

করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম ও কুষ্টিয়া এবং প্রতিনিধি, নওগাঁ]