ভাষা আন্দোলনের আদর্শ আমাকে প্রভাবিত করে। মনে করিয়ে দেয়—দেশ ও জাতির প্রতি আমার, আমাদের কিছু দায়িত্ব রয়েছে। এই দেশে যে আমরা স্বাধীনভাবে চলি, নিজের ভাষায় পড়ি, লিখি ও বলি, তা আমরা এমনি এমনি পাইনি। তাই একুশের চেতনা আমাদের জোর করে কিছু চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে লড়তে শেখায়। নিজের স্বাধীনতা আদায় করে নিতে অনুপ্রাণিত করে।
তবে চারদিকে তাকালে এখন বড় অস্থির লাগে। কেমন যেন একটা প্রচ্ছন্ন অস্থিরতা চারপাশে। এই সময়ে দাঁড়িয়ে ভাষা আন্দোলন বা মায়ের ভাষার জন্য লড়াই নিয়ে কথা বলতে খুব কি স্বস্তি লাগে? ভাষার লড়াই বা ভাষাচর্চা তো একটা সার্বক্ষণিক ব্যাপার। কিন্তু আমরা কেবল ফেব্রুয়ারি মাস এলেই ভাষার কথা মনে করি; ভাষা নিয়ে এই চর্চাটা হয় দিন কয়েকের জন্য, এর আগে কিংবা পরে ভাষার কথা খুব একটা মনে থাকে না আমাদের।
১৯৪৮ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার পূর্ববাংলা তথা বাংলাদেশের মানুষকে দাবিয়ে রাখার মানসে ঘোষণা করেছিল, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ এ সময় উর্দুর পাশাপাশি বিকল্প হিসেবে আরবি হরফে বাংলা লেখার অদ্ভুত এক প্রস্তাব সামনে আসে। আরবি হরফে বাংলা লেখার বিষয়টিকে সেদিন তারা বাংলা ভাষার ‘ইসলামীকরণ’–এর মোড়কে তুলে ধরেছিল। কিন্তু তখন তো এর বিরুদ্ধেই আমরা রুখে দাঁড়িয়েছিলাম। লড়াই করে মায়ের ভাষায় কথা বলার স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছিলাম।
কিন্তু আমরা এখন কোথায় দাঁড়িয়ে আছি? কী অবস্থায় আছে আমাদের প্রাণপ্রিয় বাংলা ভাষা? এই প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতেই আমাদের দেশের সাম্প্রতিক কিছু প্রবণতার দিকে চোখ ফেরানো যাক। অনেকেই আজকাল ইংরেজি হরফে বাংলা লেখেন। অনেক ক্ষেত্রে বাংলা বলতে সংকোচ বোধ করেন। আবার চারপাশে তাকালে এমনও দেখা যায় যে নতুন প্রজন্মের অনেক ছেলেমেয়েই বাংলা–ইংরেজি–হিন্দি মিশিয়ে একটি মিশেল ভাষায় কথা বলছে।
এদিকে তিন–চার দশক আগেও মানুষের মধ্যে নিজের সন্তানের বাংলা নাম রাখার যে সংস্কৃতি তৈরি হয়েছিল, সেই প্রবণতা অনেকটাই কমে এসেছে এখন। কেন এসবের বদল ঘটল, বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা দরকার। অনেক ক্ষেত্রে আমরা হয়তো বিষয়গুলো সেভাবে খেয়ালও করি না। কিন্তু এসব দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন; আর দরকার আমাদের মনোভাবের পরিবর্তন।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে যেকোনো ন্যায্য ও নৈতিক আন্দোলনের দিকে তাকালে দেখা যাবে, একেকটি আন্দোলনকে বেগবান করতে এবং মানুষের মনকে জাগিয়ে দেওয়ার জন্য শিল্পসাহিত্য সব সময়ই বড় ভূমিকা পালন করেছে। একজন থিয়েটারশিল্পী হিসেবে আমার মনে হয়, মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে নাটক অনেক শক্তিশালী মাধ্যম।
ভাষা সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে লেখা শহীদ মুনীর চৌধুরীর কবর নাটকটি একসময় আমাদের যেভাবে নাড়া দিয়েছিল, দেশমাতৃকার লড়াইয়ে শামিল হতে উৎসাহ জুগিয়েছিল—এটিই তো নাটকের শক্তি প্রমাণের পক্ষে যথেষ্ট। এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে এখন আমরা কাজ করতে পারি, নাটকের মাধ্যমে সমাজকে নাড়া দিতে পারি, প্রশ্ন করতে পারি। আমার কাছে একুশের চেতনা হলো প্রশ্ন করার স্বাধীনতা।
দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য কী করছি, সেটি নিয়ে আমাদের সচেতন থাকতে হবে। একুশ আমাকে নিজের কাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার পাশাপাশি একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হতে শেখায়। একুশের চেতনাকে এভাবেই মর্মে ধারণ করি আমি।
মহসিনা আক্তার: নাট্যশিল্পী