বিশ্লেষণ

বিনা মূল্যের পাঠ্যবই: অস্বাভাবিক কম দরে ছাপার মান নিয়ে শঙ্কা

কাগজের উজ্জ্বলতা ৫ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছে এনসিটিবি। আবার প্রাক্কলিত দরের চেয়ে বেশ কম দর দিয়ে বই ছাপার কাজ নিচ্ছেন মুদ্রণকারীরা।

ফাইল ছবি

চলতি বছর সময়মতো শিক্ষার্থীদের হাতে সব পাঠ্যবই তুলে দিতে পারেনি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। এ জন্য আগামী বছরের পাঠ্যবই ছাপার কাজের প্রক্রিয়া আগেভাগে শুরু করেছে তারা। তবে মাধ্যমিক স্তরে এবার প্রাক্কলিত দরের চেয়ে অস্বাভাবিক কম দরে বই ছাপানোর কাজ নিচ্ছেন মুদ্রণকারীরা।

গত বছরের চেয়ে এবার আবার ছাপার কাগজের উজ্জ্বলতার শর্ত শিথিল করেছে এনসিটিবি। গেলবারের চেয়ে ৫ শতাংশ কম উজ্জ্বলতার কাগজে বই ছাপানো হচ্ছে। এতে এনসিটিবির কিছু টাকা সাশ্রয় হলেও পাঠ্যবইয়ের মান খারাপ হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। 

অবশ্য এনসিটিবি বলছে, দরপত্রে মুদ্রণকারীরা কম দর দিলে তাঁদের কিছু করার থাকে না। আর কাগজের সংকটের কথা মাথায় রেখে এবার উজ্জ্বলতায় ছাড় দেওয়া হয়েছে।

এবার নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকেই বেশির ভাগ শ্রেণির বই ছাপা হচ্ছে। চলতি বছরে কেবল প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে। আগামী বছর থেকে দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতেও নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে বই ছাপানো হবে। ফলে বইয়ের সংখ্যা ও বিষয়বস্তুতে পরিবর্তন আসছে। তবে অন্যান্য শ্রেণিতে পুরোনো শিক্ষাক্রমের আলোকেই বই ছাপানো হবে।

এনসিটিবির সূত্রমতে, ইতিমধ্যে প্রাথমিকের বই ছাপার জন্য দরপত্র ও মূল্যায়নকাজ শেষ পর্যায়ে। অন্যদিকে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বই ছাপার আনুষঙ্গিক কাজ শেষে এখন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে নবম শ্রেণির বই লেখার কাজ এখনো শেষ হয়নি।

এনসিটিবি সূত্র জানায়, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে প্রতিষ্ঠানটি ফর্মাপ্রতি বইয়ের প্রাক্কলিত দর গড়ে প্রায় ৩ টাকা ধরেছিল। কিন্তু ষষ্ঠ শ্রেণিতে মুদ্রণকারীরা ফর্মাপ্রতি সর্বনিম্ন দর দিয়েছেন গড়ে ১ টাকা ৯৩ পয়সা। আর সপ্তম শ্রেণিতে ১ টাকা ৭৯ পয়সা। ষষ্ঠ শ্রেণিতে মোট বই ছাপা হবে প্রায় ৬ কোটি ৪৫ লাখ, আর সপ্তম শ্রেণিতে প্রায় ৪ কোটি ৪৫ লাখ।

এনসিটিবির চেয়ারম্যান মো. ফরহাদুল ইসলাম অভিযোগটি অস্বীকার করেননি। তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে চাহিদা নিয়েই তাঁরা বই ছাপেন। এখানে একাধিক বিষয় কাজ করে। প্রথমত, পরের বছর একেকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নতুন কত শিক্ষার্থী ভর্তি হবে, তার সঠিক সংখ্যা আগে থেকে তারা জানে না। এ জন্য প্রতিষ্ঠানগুলো ধারণার ভিত্তিতে চাহিদা দেয়। আবার বিভিন্ন শ্রেণির জন্যও অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেশি চাহিদা দেয়। তবে কিছু পদক্ষেপ নেওয়ায় এই সমস্যা আগের চেয়ে অনেকটা কমেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনসিটিবির এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, এতে সরকারের কিছু টাকা সাশ্রয় হবে ঠিক; কিন্তু বইয়ের মান কতটুকু রক্ষা করা যাবে, সেটিই আশঙ্কার বিষয়। কারণ, এমনিতেই মুদ্রণকারীদের একটি অংশ অতি মুনাফার জন্য প্রায় বছরই পাঠ্যবই নিয়ে ঝামেলা করেন। শেষ সময়ে যখন সরকার মুদ্রণকারীদের কাছ থেকে তাড়াতাড়ি বই আদায়ের চেষ্টা করে, তখনই অনেক মুদ্রণকারী নিম্নমানের কাগজে বই ছাপানোর চেষ্টা করেন। এবার এই আশঙ্কা আরও বেশি। 

এনসিটিবির সূত্র বলছে, গতবার কাগজের উজ্জ্বলতা ধরা হয়েছিল ৮৫ শতাংশ। এবার ধরা হয়েছে ৮০ শতাংশ। অতীত অভিজ্ঞতা হচ্ছে, অনেক মুদ্রণকারী উজ্জ্বলতার শর্ত ঠিকমতো মানেন না। যেমন গতবার ভালো মানের পাল্পের (কাগজ তৈরির মণ্ড) সংকটের কারণে উজ্জ্বলতার ক্ষেত্রে ছাড় দিয়েছিল এনসিটিবি। অথচ সেই ছাড়ের চেয়েও খারাপ কাগজে তাঁরা বই ছাপিয়েছিলেন। এবার কাগজের উজ্জ্বলতা ধরা হয়েছে ৮০ শতাংশ। এখন কায়দাকানুন করে এর চেয়ে কম উজ্জ্বলতার কাগজে বই ছাপলে স্বাভাবিকভাবেই বইয়ের মান অনেক খারাপ হবে।

অবশ্য এনসিটিবির দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, এবার তাঁরা অনেক বেশি সতর্ক থাকবেন। 

ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন

এবার ৪ কোটির বেশি শিক্ষার্থীর জন্য প্রায় ৩৪ কোটি পাঠ্যবই ছাপানো হবে। এর মধ্যে মাধ্যমিকে প্রায় ১ কোটি ৬৭ লাখ শিক্ষার্থীর জন্য ২৩ কোটির মতো বই ছাপানো হবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, দেশে মাধ্যমিক স্তরে আসলে কি এত শিক্ষার্থী আছে?

সরকারের শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইসে) হিসাবে, মাধ্যমিকে মোট শিক্ষার্থী ১ কোটির কিছু বেশি। সেখানে মাদ্রাসার শিক্ষার্থী যোগ করলেও মোট সংখ্যা ১ কোটি ৬৭ লাখ হওয়ার কথা নয়। 

অভিযোগ আছে, এমন ঘটনা শুধু এবারই হয়েছে তা নয়, প্রায় প্রতিবছরই শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি দেখিয়ে বই ছাপানো হয়। বিপুলসংখ্যক বই বেশি ছাপার কারণে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়।

এনসিটিবির চেয়ারম্যান মো. ফরহাদুল ইসলাম অভিযোগটি অস্বীকার করেননি। তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে চাহিদা নিয়েই তাঁরা বই ছাপেন। এখানে একাধিক বিষয় কাজ করে। প্রথমত, পরের বছর একেকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নতুন কত শিক্ষার্থী ভর্তি হবে, তার সঠিক সংখ্যা আগে থেকে তারা জানে না। এ জন্য প্রতিষ্ঠানগুলো ধারণার ভিত্তিতে চাহিদা দেয়। আবার বিভিন্ন শ্রেণির জন্যও অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেশি চাহিদা দেয়। তবে কিছু পদক্ষেপ নেওয়ায় এই সমস্যা আগের চেয়ে অনেকটা কমেছে।