'আমার ছেলে কি চুরি করেছে, নাকি ডাকাতি করেছে। আমার ছেলের কী অপরাধ? আমার ছেলেকে বললে ও নিজেই থানায় গিয়ে হাজির হতো। কেন এভাবে রাতে আমার ছেলেকে তুলে নেওয়া হলো?' কথাগুলো বলছিলেন প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামানের মা করিমন নেসা। ছেলেকে পুলিশ ধরে নেওয়ার খবর শোনার পর থেকে বুক চাপড়ে কান্না করছেন তিনি।
শামসুজ্জামান প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক। ঢাকার সাভারে দায়িত্বরত তিনি। আজ বুধবার ভোররাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়–সংলগ্ন আমবাগান এলাকার বাসা থেকে সিআইডি পরিচয় দিয়ে কয়েকজন তাঁকে তুলে নিয়ে আসেন। শামসুজ্জামানের মা করিমন নেসা তখন ছিলেন মানিকগঞ্জ সদরের কাটিগ্রামে নিজেদের বাড়িতে। তিনি ছেলেকে ধরে নেওয়ার খবর পান সকাল ১০টার পর। এর পর থেকে চলতে থাকে তাঁর বিলাপ।
করিমন নেসার স্বামী মারা গেছেন ২০০৬ সালে। দুই ছেলে তখনো ছাত্র। তাঁদের পড়াশোনা করান করিমন নেসা। বড় ছেলে রবিউল করিম সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর কিছুটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন তিনি। সংসারের হাল ধরেন বড় ছেলে। কিন্তু ২০১৬ সালে গুলশানের হোলি আর্টিজানে জঙ্গিরা হামলা চালালে তাদের রুখতে প্রথমে যে পুলিশ সদস্যরা গিয়েছিলেন, তাঁদের সামনের কাতারে ছিলেন গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তৎকালীন সহকারী কমিশনার রবিউল করিম। জঙ্গিদের হামলায় প্রাণ হারিয়েছিলেন। বড় ছেলেকে হারানোর পর একমাত্র সন্তান শামসুজ্জামানকে ঘিরেই করিমন নেসার জগৎ।
সেই ছেলেকে পুলিশ ধরে নেওয়ার খবরে কপাল আর বুক চাপড়ে কান্না শুরু করেন করিমন নেসা। তাঁর আচরণ দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন প্রতিবেশীরা। তাঁরা খবর দেন করিমন নেসার ভাইদের। খবর পেয়ে তাঁর ছোট ভাই মো. ইসমাইল মানিকগঞ্জে গিয়ে বোনকে নিজের বাড়ি ধামরাইয়ে নিয়ে আসেন।
দুপুরে মানিকগঞ্জের কাটিগ্রামে শামসুজ্জামানদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সব ঘরে তালা ঝুলছে। বাড়ির উঠানে বসে ছিলেন কয়েকজন নারী। তাঁদের একজন আমেনা বেগম শামসুজ্জামানের মায়ের চাচিশাশুড়ি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সকালে শামসকে (শামসুজ্জামান) তুলে নেওয়ার খবর আসে গ্রামে। এর পর থেকে অনেকটা পাগলের মতো আচরণ করতে থাকেন তাঁর মা করিমন নেসা। বুক চাপড়ে, কপাল চাপড়ে কাঁদতে থাকেন তিনি। তাঁর কান্না শুনে প্রতিবেশীরা ছুটে আসেন। বড় ছেলে যখন মারা যান, তখনো তাঁর কান্না দেখেছেন প্রতিবেশীরা। ভেবেছেন হয়তো ছোট ছেলের কিছু হয়েছে। পরে তাঁরা জানতে পারেন, কিছু লোক শামসকে ধরে নিয়ে গেছে।
আমেনা বেগম বলছিলেন, ছেলের চিন্তায় করিমন পাগলের মতো আচরণ করছিল। বেলা একটার দিকে তাঁর ভাই ইসমাইল হোসেন গাড়ি নিয়ে এসে তাঁকে নিয়ে যান।
ইসমাইল হোসেনের বাড়ি ঢাকার ধামরাইয়ের ডাউটিয়া গ্রামে। বাড়িতে ঢোকার আগেই করিমন নেসার কান্নার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বারবার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলেন।
করিমন নেসা বলছিলেন, ‘আল্লাহ আমার স্বামীরে নিছ, এক সন্তানরে নিছ। আমার এই সন্তানকে বুকে ফিরায় দাও আল্লাহ, আমি আর কিচ্ছু চাই না। আমার সন্তান ঘরে থাকব, আমি ওর মা ডাক শুনব।’
শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, এমন খবর শুনে করিমন নেসা বলেন, ‘আমার পোলায় কি চোর না ডাকাত, ওরে কিসের মামলায় দিছে? আমি খালি চাই, আমার ছেলে বুকে ফিরে আসুক।’
করিমন নেসার ভাই ইসমাইল হোসেন বলছিলেন, ‘দুর্ভাগ্য বোনটার পিছু ছাড়ছে না। বড় ছেলে যাওয়ার পর এই ছোট ছেলেই তাঁর সবকিছু। ছেলের খবর শোনার পর থেকেই পাগলের মতো করছে ও।’
উল্লেখ্য, গত রোববার প্রথম আলো অনলাইনের একটি প্রতিবেদন ফেসবুকে প্রকাশের সময় দিনমজুর জাকির হোসেনের উদ্ধৃতি দিয়ে একটি ‘কার্ড’ তৈরি করা হয়। সেখানে উদ্ধৃতিদাতা হিসেবে দিনমজুর জাকির হোসেনের নাম থাকলেও ভুল করে ছবি দেওয়া হয় একটি শিশুর। পোস্ট দেওয়ার ১৭ মিনিটের মাথায় অসংগতিটি নজরে আসে এবং দ্রুত তা প্রত্যাহার করা হয়। পাশাপাশি প্রতিবেদন সংশোধন করে সংশোধনীর বিষয়টি উল্লেখসহ পরে আবার অনলাইনে প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনের কোথাও বলা হয়নি যে উক্তিটি ওই শিশুর। বরং স্পষ্টভাবেই বলা হয়েছে, উক্তিটি দিনমজুর জাকির হোসেনের।
প্রতিবেদনটির প্রতিবেদক ছিলেন শামসুজ্জামান। তাঁকে আজ বুধবার ভোর চারটার দিকে তাঁর সাভারের বাসা থেকে সিআইডির পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়। তাঁর নামে ঢাকার তেজগাঁও থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা করেছেন সৈয়দ মো. গোলাম কিবরিয়া (৩৬) নামের এক ব্যক্তি। মামলার এজাহারে গোলাম কিবরিয়ার পরিচয়ে লেখা হয়েছে, তিনি ঢাকার কল্যাণপুরের বাসিন্দা। তাঁর ফেসবুক পেজে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, তিনি যুবলীগের ঢাকা মহানগর উত্তরের ১১ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক। তিনি আগে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন।