লোকবলসংকটে ব্যাহত পাসপোর্ট সেবা

দৈনিক ২,৫৬০টি আবেদন ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা আছে। জমা পড়ে ৩ হাজারের অধিক আবেদন। এত মানুষ দাঁড়ানোর মতো পর্যাপ্ত জায়গাও নেই।

পর্যাপ্ত জায়গা ও ভৌত অবকাঠামোর সংকটে পাসপোর্ট অফিসে এভাবে ভিড় লেগে থাকে। সম্প্রতি রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পাসপোর্ট অফিসে

দৈনিক দুই থেকে আড়াই হাজার ব্যক্তি আবেদন নিয়ে আসেন ঢাকার আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসে। তাঁদের সঙ্গে আসেন আরও প্রায় দুই হাজার আত্মীয় বা স্বজন। এই বিপুলসংখ্যক মানুষের সেবা দেওয়ার মতো জনবল এবং ভৌত অবকাঠামো বা পর্যাপ্ত জায়গা নেই এই পাসপোর্ট অফিসে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে পাসপোর্ট পেতে দেরি হচ্ছে। কর্তৃপক্ষ বলছে, এসব সমস্যার পরও প্রতি কর্মদিবসে দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার পাসপোর্ট মানুষকে সরবরাহ করা হচ্ছে।

ঢাকা পাসপোর্ট ও ভিসা অফিস সূত্র জানায়, ঢাকার আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসে দৈনিক ২ হাজার ৫৬০টি আবেদন ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা আছে। কিন্তু জমা পড়ে তিন হাজারের অধিক আবেদন। এ ছাড়া প্রতিদিন জমা পড়া আবেদনের মধ্যে ৮০০ থেকে এক হাজার আবেদনে কোনো না কোনো ত্রুটি থাকে।

আগারগাঁও অফিসের কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন, পাসপোর্টের জন্য প্রতিদিন যত আবেদন জমা পড়ে, তাঁদের দ্রুত সেবা দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত জনবল নেই। এমনকি এই বিপুলসংখ্যক সেবাগ্রহীতার জন্য এই অফিসে পর্যাপ্ত জায়গাও নেই। ফলে সব সময় সেখানে মানুষের ভিড় লেগেই থাকে। কর্মকর্তাদের মতে, বর্তমানে যে জনবল ও জায়গা রয়েছে, তাতে দিনে ৪০০ থেকে ৪৫০টি আবেদন জমা পড়লে সুন্দরভাবে সেবা দেওয়া সম্ভব।

প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক নতুন আবেদন এবং ভুল সংশোধনের আবেদন জমা পড়ে। এসব আবেদন সঠিক সময়ের মধ্যে সমাধান করে সেবা দিতে চাইলে শুধু ঢাকাতেই জরুরি ভিত্তিতে আরও অন্তত ১০টি অফিস দরকার।
মো. আবদুল্লাহ আল মামুন, ঢাকা বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসের পরিচালক

দেশে ৬৯টি পাসপোর্ট অফিস রয়েছে। তবে সারা দেশ থেকেই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ পাসপোর্ট নিতে আসেন ঢাকার আগারগাঁও অফিসে। ফলে চাপ অনেক বেশি হয় জানিয়ে সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, সবাই যদি নিজ নিজ জেলা বা এলাকার পাসপোর্ট অফিসে এই সেবা নিতে যান, তাহলে এই চাপ কমে আসবে। পাশাপাশি সেবার মানও বৃদ্ধি পাবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, নতুন পাসপোর্টের জন্য আবেদনকারীদের মধ্যে গড়ে ৮৫ শতাংশ আবেদনে ভুল পাওয়া যায়। আবেদনপত্র নির্ভুল না হলে সঠিক সময়ে পাসপোর্ট দেওয়া যায় না। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, নতুন আবেদনকারীদের ভুল-ত্রুটি দ্রুত সময়ের মধ্যে সমাধান করা গেলেও সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয় পুরোনো পাসপোর্টধারীদের ভুল তথ্য সংশোধনে। ভুল তথ্য সংশোধনের জন্য আবেদন করার পর বায়োমেট্রিক করতে হয়। তারপর ওই আবেদন পুলিশি যাচাইয়ের (ভেরিফিকেশন) পাঠানো হয় সংশ্লিষ্ট এলাকার পুলিশের কাছে। পুলিশের প্রতিবেদন পাওয়ার পর আবেদনপত্রটি ভিসা ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের বোর্ডে পাঠানো হয়। এসব প্রক্রিয়া শেষ করতে অনেক লম্বা সময় লেগে যায়।

এর বাইরে দেশ-বিদেশ থেকে দিনে প্রায় ৫০০টি আবেদন আসে নানা ভুল সংশোধন চেয়ে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আবেদন আসে নাম, বয়স ও ঠিকানা পরিবর্তনের। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসের পরিচালক মো. আবদুল্লাহ আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক নতুন আবেদন এবং ভুল সংশোধনের আবেদন জমা পড়ে। এসব আবেদন সঠিক সময়ের মধ্যে সমাধান করে সেবা দিতে চাইলে শুধু ঢাকাতেই জরুরি ভিত্তিতে আরও অন্তত ১০টি অফিস দরকার। দ্রুত সেবা দেওয়ার জন্য অফিসগুলোর ভৌত অবকাঠামোগত পরিবর্তন দরকার।

পাসপোর্ট অফিস সূত্র জানায়, প্রতিটি আবেদনের জন্য বায়োমেট্রিক করতে হয়। একেকটি বায়োমেট্রিকের জন্য ৫ থেকে ১৫ মিনিট সময় লাগে। ফলে আবেদনকারীকে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। আবার অনেক সময় আবেদনকারী প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সঙ্গে আনেন না। এ কারণে তাঁদের ফেরত পাঠানো হয়। বাইরে এসে আবেদনকারীরা ভোগান্তির কথা বলেন বা তাঁদের ঘোরানো হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন।

‘ছবি তুলতে ও আঙুলের ছাপ দিতে লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হয়। এ ছাড়া পাসপোর্ট পেতে আর কোনো সমস্যা নেই। আমি নিজে আবেদনপত্র পূরণ করেছি। কোনো দালাল ধরিনি।’
তৌহিদুজ্জামান

আবার প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ সঠিকভাবে আবেদনপত্র পূরণ করে জমা দিলে নির্ধারিত সময়ে পাসপোর্ট পাওয়ার উদাহরণও আছে। ঢাকার মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা তৌহিদুজ্জামান, চাকরি করেন একটি বেসরকারি কোম্পানিতে। তিনি নিজে গত ৮ জুন অনলাইনে আবেদনপত্র পূরণ করেন এবং ব্যাংকে টাকা জমা দেন। টাকা জমা দেওয়ার চার দিন পর রাজধানীর আগারগাঁও পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসে গিয়ে ছবি তুলে আঙুলের ছাপ দেন। ৪ জুলাই পুলিশ প্রতিবেদন আসে। ৬ জুলাই তিনি পাসপোর্ট হাতে পেয়েছেন।

তৌহিদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছবি তুলতে ও আঙুলের ছাপ দিতে লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হয়। এ ছাড়া পাসপোর্ট পেতে আর কোনো সমস্যা নেই। আমি নিজে আবেদনপত্র পূরণ করেছি। কোনো দালাল ধরিনি।’

সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, সেবা পেতে দেরি হলে সবাই কেবল পাসপোর্ট অফিসকে দোষ দেন। কিন্তু পাসপোর্ট দেওয়ার ক্ষেত্রে শুধু পাসপোর্ট ও ভিসা অফিস কাজ করে না। এর সঙ্গে ব্যাংক, জন্মনিবন্ধন সনদ (বিআরসি) ও জাতীয় পরিচয়পত্রের সার্ভারের কাজ রয়েছে। কোনো কারণে কোনো একটি সংস্থার সার্ভারে ঝামেলা হলে পাসপোর্ট অফিসের চলমান কাজে বিঘ্ন ঘটে। আবার অনেক সময় পুলিশের প্রতিবেদন পেতেও দেরি হয়।

কত রকম ঝামেলা নিয়ে মানুষ পাসপোর্ট অফিসে আসেন সেটা বলতে গিয়ে ঢাকা বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসের সহকারী পরিচালক মো. ইউসুফ প্রথম আলোকে বলেন, এক ব্যক্তি পাসপোর্ট করার পর মেয়াদ শেষে আরও দুবার নতুন পাসপোর্ট নিয়েছেন। বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করেছেন। এখন এসেছেন বাবার নাম পরিবর্তন করতে। তাঁকে বলা হলো, দুই থেকে তিন মাস সময় লাগবে। কিন্তু তিনি মানতে চান না। তাঁর মতে, একটা নামের পরিবর্তন করতে কেন এত সময় লাগবে।

এমন নানা কারণে পাসপোর্ট সেবা পেতে বিলম্ব বা ভোগান্তি থেকে রেহাই পেতে অনেকে দালালের শরণাপন্ন হন। যার ফলে পাসপোর্ট অফিসের আশপাশে দালালের তৎপরতার অভিযোগ অনেক পুরোনো। আবার পাসপোর্ট অফিসের কর্মচারীদের কেউ কেউ অনেক সময় দালালদের ভূমিকায় নামেন।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘দু-একটা পাসপোর্ট দেওয়ার ক্ষেত্রে যে আর্থিক লেনদেন হয় না, সেটা বলব না। আমাদের দু-একজন অফিস সহকারী টাকা নিয়ে আবেদনকারীদের আত্মীয়স্বজন বলে কাজ করিয়ে নেন। তবে সেই সংখ্যা বেশি নয়।’