মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত অভিযোগে আরও ৯ জনকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। গত তিন দিন ঢাকা, দিনাজপুর ও নীলফামারী এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাজ্জাদ হোসেন, নীলফামারীর একটি কোচিং সেন্টারের পরিচালক এবং বিভিন্ন হাসপাতালের পাঁচজন চিকিৎসক রয়েছেন।
গ্রেপ্তার অন্যরা হলেন নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার বিটস কোচিংয়ের পরিচালক আবদুল হাফিজ ওরফে হাপ্পু, পাঁচ চিকিৎসক ফয়সাল আহমেদ ওরফে রাসেল, সোহানুর রহমান ওরফে সোহান, তৌফিকুল হাসান ওরফে রকি, ফয়সাল আলম ওরফে বাদশা ও ইবরার আলম। গ্রেপ্তার অপর দুই ব্যক্তি হলেন রায়হানুল ইসলাম ওরফে সোহান ও বকুল রায় ওরফে শ্রাবণ। তাঁদের কাছ থেকে ৯টি মুঠোফোন, ২টি ল্যাপটপ, বিভিন্ন ব্যাংকের চেক ও চেকবই, ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড জব্দ করা হয়েছে। গত তিন বছরে এ নিয়ে মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত অভিযোগে মোট ৪৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হলো। তাঁদের মধ্যে ২৩ জন চিকিৎসক রয়েছেন।
সিআইডির গণমাধ্যম শাখার বিশেষ পুলিশ সুপার মো. আজাদ রহমান আজ বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা সবাই মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। গ্রেপ্তার আসামিদের কাছ থেকে চক্রের অন্যান্য সদস্য ও অসাধু উপায়ে বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়া বহু শিক্ষার্থীর নাম পাওয়া গেছে। এর আগে এই চক্রের হোতা জসীম উদ্দিন ভূঁইয়া ওরফে মুন্নুর কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া গোপন ডায়েরি থেকে সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা চক্রের সদস্যদের সন্ধান পায় সিআইডি।
সিআইডি সূত্র জানায়, গ্রেপ্তার সাজ্জাদ হোসেন দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার ৩ নম্বর সিংড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। তিনি ২০১০ সাল থেকে প্রশ্নফাঁস চক্রের সঙ্গে জড়িত। তিনি চক্রের হোতা জসীমের গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী। সাজ্জাদ ২০১৭ সালে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের অন্য আরেকটি মামলারও এজাহারভুক্ত আসামি।
সাজ্জাদ উত্তরবঙ্গের বহু শিক্ষার্থীকে অনৈতিক উপায়ে মেডিকেলে ভর্তি করিয়ে কোটি টাকার ওপরে হাতিয়ে নিয়েছেন। আগে গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে তাঁর নাম এসেছে। গ্রেপ্তার আবদুল হাফিজ কোচিং সেন্টার চালানোর পাশাপাশি দিনাজপুরে একটি বেসরকারি হাসপাতালের মালিক। আগে গ্রেপ্তার হওয়া চিকিৎসক জিল্লুর হাসান রনির মাধ্যমে প্রশ্ন পেয়ে দীর্ঘদিন ধরে তিনি তাঁর কোচিংয়ের শিক্ষার্থীদের অনৈতিক উপায়ে মেডিকেলে ভর্তি করিয়েছেন। ওই শিক্ষার্থীদের বেশ কয়েকজনকে ইতিমধ্যে শনাক্ত করেছে সিআইডি।
সিআইডি জানায়, গ্রেপ্তার চিকিৎসক সোহানুর রহমান বিটস কোচিং সেন্টারের পরিচালক আবদুল হাফিজের কাছ থেকে ২০১৩ সালে প্রশ্ন পেয়ে পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। পরে তিনি বিসিএস স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসেবে পার্বতীপুরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যোগ দেন। গ্রেপ্তার চিকিৎসক ফয়সাল আহমেদ ইউপি চেয়ারম্যান সাজ্জাদ হোসেনের মাধ্যমে ২০১০ সালে মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন পেয়ে জাতীয় মেধাতালিকায় ১১তম স্থান পান এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। এরপর যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পে দিনাজপুর সিভিল সার্জন কার্যালয়ে সার্ভেইল্যান্স চিকিৎসা কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন। ফয়সাল পরে প্রশ্নফাঁসের কারবারে জড়িয়ে পড়েন।
সিআইডি কর্মকর্তারা বলেন, গ্রেপ্তার তৌফিকুল ইসলাম প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে আগে গ্রেপ্তার হওয়া চিকিৎসক জিল্লুর হাসানের গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী ছিলেন। তাঁরা দুজনই রংপুর মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন। পরে তিনি মেডিকেল কলেজের প্রশ্নপত্র ফাঁসের কারবারে জড়িয়ে পড়েন। তৌফিকুল বিটস কোচিংয়েও ক্লাস নিতেন। আবদুল হাফিজ, চিকিৎসক তৌফিকুল ও চিকিৎসক জিল্লুর মিলে অনৈতিক উপায়ে বেশ কিছু শিক্ষার্থীকে দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে ভর্তি করিয়েছেন। চিকিৎসক জিল্লুর আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে চিকিৎসক তৌফিকুলের নাম এসেছে।
সিআইডি জানায়, রংপুর মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করা ইবরার আলমও চিকিৎসক জিল্লুর সহযোগী ছিলেন। চিকিৎসক জিল্লুরের জবানবন্দিতে তাঁর নাম এসেছে। ইবরার ২০১৩ ও ২০১৫ সালের ভর্তি পরীক্ষার আগের রাতে চিকিৎসক জিল্লুরের মাধ্যমে প্রশ্ন পেয়ে বেশ কিছু শিক্ষার্থীকে টাকার বিনিময়ে তা সরবরাহ করেছিলেন। তাঁদের অনেকেই বিভিন্ন মেডিকেলে ভর্তি হয়েছেন।
সিআইডি কর্মকর্তারা বলেন, গ্রেপ্তার রায়হানুল ইসলাম ও বকুল রায় দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার বাসিন্দা। দুজনই একই স্কুলে পড়তেন এবং পরস্পর ঘনিষ্ঠ। রায়হানুল ২০১৫ সালে তাঁর এক মামার মাধ্যমে মেডিকেলের ফাঁস হওয়া প্রশ্ন পান এবং বকুলকে তা সরবরাহ করেন। বকুল তা চার ভর্তি-ইচ্ছুক ছোট ভাইয়ের কাছে বিক্রি করেন। চারজনই দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান। গ্রেপ্তার চিকিৎসক সাইফুল আলম ২০১০ সালে সাজ্জাদ হোসেনের মাধ্যমে প্রশ্ন পেয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। এরপর প্রশ্নপত্র ফাঁস ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। ২০১৩ ও ২০১৫ সালে তিনি একাধিক শিক্ষার্থীকে প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাধ্যমে মেডিকেলে ভর্তি করিয়েছেন।