রাজধানীতে দেড় বছরের ব্যবধানে ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্ট পরিচয় দিয়ে এক ব্যক্তি দুজনের কাছ থেকে দামি মোটরসাইকেল নিয়ে হাওয়া হয়ে গেছেন। এ ঘটনায় মামলা হলেও সার্জেন্ট পরিচয় দেওয়া ওই ব্যক্তিকে খুঁজে বের করতে পারেনি পুলিশ।
মামলার কাগজপত্রের তথ্য বলছে, ২০২২ সালের ১ মার্চ রাজধানীর ধানমন্ডিতে সার্জেন্ট পরিচয় দিয়ে কাগজপত্র পরীক্ষার ছলে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর সুজুকি ব্র্যান্ডের (দাম ২ লাখ ৫৫ হাজার টাকা) মোটরসাইকেল নিয়ে যান ওই দুর্বৃত্ত। এর দেড় বছর পর ১ মার্চ একইভাবে বনানী থেকে আরেক বেসরকারি চাকরিজীবীর সুজুকি ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল নিয়ে যান তিনি। ভুক্তভোগী দুই মোটরসাইকেল চালকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সার্জেন্ট পরিচয়ে মোটরসাইকেল নিয়ে যাওয়ার পর দুবারই ওই ব্যক্তি ঘটনাস্থলে আরেকটি মোটরসাইকেল রেখে যান।
জানতে চাইলে বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী সাহান হক প্রথম আলোকে বলেন, সার্জেন্ট পরিচয় দিয়ে মোটরসাইকেল ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় মামলা হয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনা হবে।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন রাইসুল ইসলাম। থাকেন মিরপুর এলাকায়। ১ মার্চ সকালে মোটরসাইকেল নিয়ে তিনি রাজধানীর পূর্বাচলে ঘুরতে যান। বিকেলে ফেরার পথে তিনি যখন বনানীর ডলফিন ভাস্কর্য চত্বরের উল্টো দিকে আসেন, তখন পুলিশের সার্জেন্ট পরিচয় দিয়ে সাদা পোশাকের এক ব্যক্তি তাঁকে থামান। তিনি রাইসুলকে গাড়ির কাগজপত্র দিতে বলেন। রাইসুল গাড়ির চাবি ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তাঁর হাতে তুলে দেন। এরপর লোকটি রাইসুলের গাড়ির পেছনে গিয়ে নম্বরপ্লেটের ছবি তোলেন। ডিজিটাল নম্বরপ্লেট কেন করেননি, সেটি নিয়ে রাইসুলকে বারবার জেরা করেন ওই ব্যক্তি। এক পর্যায়ে গাড়ি ডাম্পিং করার কথা বলে মোটরসাইকেলটি নিয়ে চলে যান পুলিশের সার্জেন্ট পরিচয় দেওয়া ব্যক্তি।
গাড়ি নেওয়ার পর হতবাক হয়ে যাওয়া রাইসুল এ সময় আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন। তখন পথচারীদের কাছে মোটরসাইকেল নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন তিনি। একপর্যায়ে পথচারীদের পরামর্শে রাইসুল জাতীয় জরুরি সেবা–৯৯৯ এ ফোন দেন। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে। তখন সেখানে একটি মোটরসাইকেল দেখতে পান তাঁরা। পরে মোটরসাইকেলটি বনানী থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। ওই গাড়ির চেসিস নম্বরসহ প্রয়োজনীয় তথ্য নিয়ে মোটরসাইকেল বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করেন রাইসুল। তখন গাড়ির প্রকৃত মালিকের নাম ও ঠিকানা জানতে পারেন তিনি। যোগাযোগ করলে মোটরসাইকেলটির মালিক শরীফ মো. জুনায়েদ তখন রাইসুলকে জানান, তাঁর এই মোটরসাইকেলও পুলিশ সার্জেন্ট পরিচয় দিয়ে এক ব্যক্তি একই কায়দায় নিয়ে গিয়েছিলেন। কাকতলীয়ভাবে ওই ব্যক্তি তখনও একটি মোটরসাইকেল রেখে গিয়েছিলেন।
সেই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ভুক্তভোগী শরীফ মো. জুনায়েদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বসুন্ধরা থেকে আমি যখন ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে ট্রাফিক সিগন্যালের সামনে পৌঁছাই, তখন সাদা পোশাকের এক ব্যক্তি পুলিশ সার্জেন্ট পরিচয়ে আমাকে থামান। গাড়ির কাগজপত্র দেখার পর ডাম্পিং করার কথা বলে ওই লোক আমার গাড়ি নিয়ে চলে যান। দেড় বছর পর একই কায়দায় তিনি একই ঘটনা ঘটিয়েছেন।’
মামলার কাগজপত্র ও ভুক্তভোগী দুই মোটরসাইকেল মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ট্রাফিক সার্জেন্ট পরিচয় দেওয়া ব্যক্তির উচ্চতা ৫ ফুট ৬ ইঞ্চির বেশি। পেশাদার পুলিশের মতো আচরণ করে তাঁদেরকে ঘাবড়ে দিয়েছিলেন।
সর্বশেষ ভুক্তভোগী রাইসুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি কল্পনাও করিনি যে, ট্রাফিক সার্জেন্ট পরিচয় দেওয়া ব্যক্তি ভুয়া পুলিশ সদস্য। গাড়ি থামানো থেকে শুরু করে আমার গাড়ির কাগজপত্র নেওয়া, গাড়ির নম্বরপ্লেটের ছবি তোলাসহ যাবতীয় আচরণ ছিল পেশাদার পুলিশ সদস্যদের মতো। সত্যিকারের ট্রাফিক সার্জেন্ট মনে করেই আমি গাড়ির চাবি এবং কাগজপত্র তাঁর কাছে তুলে দিয়েছিলাম।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বনানী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. এজাজুল হক প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ সার্জেন্ট পরিচয় দেওয়া ব্যক্তিকে খুঁজে বের করতে সব ধরনের চেষ্টা চলছে। তবে ঘটনাস্থলের আশপাশের সিসি ক্যামেরার কোনো ফুটেজ পাওয়া যায়নি। পুলিশ কর্মকর্তা এজাজুল হক বলেন, এই প্রতারকের আচরণ রহস্যময়। মোটরসাইকেল নিয়ে যাওয়ার পর ঘটনাস্থলে আরেকটি মোটরসাইকেল রেখে যাচ্ছেন তিনি।
এ বিষয়ে বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী সাহান হক প্রথম আলোকে বলেন, সার্জেন্ট পরিচয় দিয়ে যে ব্যক্তি মোটরসাইকেল নিয়ে যাচ্ছেন, তাঁকে ধরতে পুলিশের পাশপাশাপি অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থাও কাজ করছে। যে কোনো মূল্যে ওই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হবে।
প্রথম ভুক্তভোগী শরীফ মো. জুনায়েদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বনানী থেকে উদ্ধার হওয়া আমার মোটরসাইকেলটি থানা চত্বরে গিয়ে দেখে এসেছি। পুলিশ পরিচয় দেওয়া ব্যক্তিটি আমার মোটরসাইকেলটি ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহার করেছেন বলে ধারণা করছি। কারণ, মালামাল নেওয়ার জন্য হুকও লাগানো হয়েছে।’
মামলার দেড় বছরেও পুলিশ কাউকে শনাক্ত করতে না পারায় হতাশা প্রকাশ করেন শরীফ মো. জুনায়েদ। দ্রুত প্রতারককে গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করার দাবি জানান তিনি। একই কথা বলেন ভুক্তভোগী রাইসুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘সার্জেন্ট পরিচয়ে যে ব্যক্তি আমার শখের মোটরসাইকেল নিয়ে গেছে, তাঁকে অবিলম্বে ধরা হোক।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের গুলশান বিভাগের (ট্রাফিক বিভাগ) উপকমিশনার মো. আবদুল মোমেন প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশের নির্ধারিত ইউনিফর্ম ছাড়া কোনো পুলিশ সার্জেন্ট রাস্তায় দায়িত্ব পালন করেন না। কেউ যদি পুলিশের সার্জেন্ট বা অন্য কোনো বিভাগের সদস্য পরিচয় দেন, তখন নাগরিকের দায়িত্ব হচ্ছে, ওই ব্যক্তির পরিচয় নিশ্চিত হওয়া। পরিচয় নিশ্চিত না হয়ে গাড়ির চাবি কিংবা কাগজপত্র তুলে দেওয়া ঠিক নয়।