সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি খুনের ১১ বছর পাঁচ মাস ২৬ দিন পূর্ণ হলো আজ সোমবার। এত বছরেও আলোচিত এই জোড়া খুনের মামলার তদন্তই শেষ করতে পারেনি র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য আজ সোমবার র্যাবকে ১০০তম বার সময় দিয়েছেন আদালত।
এত বছরেও তদন্ত শেষ না হওয়ার বিষয়ে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে র্যাব এই সাংবাদিক দম্পতির মামলাটি তদন্ত করছে। তবে একটি মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য যত ধরনের উপাদান প্রয়োজন হয়, তার সব কটি এখনো সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। ফলে আদালতে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে নিয়মিতভাবে আদালতকে আমরা অগ্রগতি প্রতিবেদন জমা দিয়ে আসছি।’
র্যাবের এই মুখপাত্র আরও বলেন, সাগর-রুনি খুনের প্রকৃত কারণ কী, কারা খুনে জড়িত, সেটি সুনিশ্চিতভাবে বলার মতো সুনির্দিষ্ট তথ্য–প্রমাণ এখনো র্যাবের কাছে আসেনি। তবে তথ্য সংগ্রহ চলমান রয়েছে।
তবে ১০০তম বার সময় নিয়েও তদন্ত প্রতিবেদন জমা না দেওয়া অস্বাভাবিক ঘটনা বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ নুরুল হুদা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কেন ১০০তম বার সময় নিয়েও র্যাব আলোচিত এই সাংবাদিক দম্পতি খুনের মামলার তদন্ত শেষ করতে পারল না, আদালত র্যাবের কাছে ব্যাখ্যা চাইতে পারেন। ১০০তম বার সময় চাওয়া অগ্রহণযোগ্য। আদালত তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য সময় বেঁধে দিতে পারেন।’
রাজধানীর শেরেবাংলা থানাধীন পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া বাসায় ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি খুন হন সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি। সেদিন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন (প্রয়াত) বলেছিলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তার করা হবে। খুনের দুই দিন পর পুলিশের তৎকালীন মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহামুদ খন্দকারও বলেছিলেন, তদন্তের ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে। তবে এই জোড়া খুনের সাড়ে ১১ বছরেও তদন্তের অগ্রগতি নেই।
নিহত সাগর সারওয়ারের মা সালেহা মনির প্রথম আলোকে বলেন, ‘তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তারের আশ্বাস দিয়েছিলেন। অথচ ১০০তমবার সময় নিয়েও র্যাব আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারে না। এত বছরেও যখন কিছু হলো না, তখন আমার মনে হচ্ছে, এই খুনের কুলকিনারা করতে পারবে না র্যাব। র্যাব যদি কিছু করতে না পারে, তাহলে আদালত অন্য কোনো সংস্থাকে তদন্তের দায়িত্ব দিক। এভাবে তো চলতে পারে না।’
তদন্তের ফলাফল না জেনেই গত বছর মারা গেছেন সাংবাদিক রুনির মা নূরণ নাহার মির্জা। আর সাগরের মাও অসুস্থ। খুনের সময় এই সাংবাদিক দম্পতি খুনের সময় তাঁদের সাড়ে চার বছরের ছেলে মাহির সরওয়ার মেঘ এখন ও লেভেলে পড়ে।
তদন্তের সময় বেঁধে দেওয়া হোক
সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি খুনের পর তদন্তে নামে শেরে-বাংলানগর থানা-পুলিশ। চার দিনের মাথায় তদন্তভার যায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে। ৬২ দিনের মাথায় তদন্তের ব্যর্থতা স্বীকার করার পর তদন্তের দায়িত্ব যায় র্যাবের কাছে। বিগত সাড়ে ১১ বছরে আদালতে জমা দেওয়া র্যাবের ১০টি অগ্রগতি প্রতিবেদনের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০১৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি লিখিতভাবে র্যাব আদালতকে জানিয়েছিল, সাগর-রুনির বাসা থেকে জব্দ করা আলামতের ডিএনএ পর্যালোচনায় অজ্ঞাতপরিচয় দুই পুরুষের উপস্থিতি মিলেছে। অজ্ঞাতপরিচয় দুই পুরুষকে শনাক্ত করতে যুক্তরাষ্ট্রের ইনডিপেনডেন্ট ফরেনসিক সার্ভিসেস (আইএফএস) ল্যাবে ডিএনএ পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে ছবি প্রস্তুতির চেষ্টা চলছে।
র্যাবের মুখপত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন প্রথম আলোকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ল্যাবের ডিএনএ প্রতিবেদন র্যাবের কাছে এসেছে। তাতে তদন্তের বড় ধরনের কোনো অগ্রগতির খবর নেই। কোনো খুনির সুনির্দিষ্ট অবয়ব সেখান থেকে জানা সম্ভব হয়নি।
তদন্তের অগ্রগতি না থাকার বিষয়ে ঢাকা মহানগরের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর আবদুল্লাহ আবু প্রথম আলোকে বলেন, ‘এত বছরেও সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি খুনের তদন্তের অগ্রগতি না হওয়াটা বিব্রতকর। তবে তদন্তের ফলাফল যাই হোক, সেটি তদন্ত প্রতিবেদন আকারে আদালতকে জমা দেওয়া উচিত। আর উচ্চ আদালত কিন্তু তদন্ত সংস্থাকে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য সময় বেঁধে দিতে পারেন।’
তবে চার বছর আগে (২০১৯ সাল) হাইকোর্টও বলেছিলেন, দীর্ঘ সময়েও অপরাধীদের চিহ্নিত করে বিচারের মুখোমুখি করতে না পারাটা নিঃসন্দেহে হতাশার।
সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি খুনের মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য ১০০তম বার সময় নেওয়া অগ্রহণযোগ্য এবং দুঃখজনক ঘটনা। তদন্ত সংস্থারই দায়িত্ব, যত দ্রুত সম্ভব আদালতে প্রতিবেদন জমা দেওয়া।
আর ১০০তম বার সময় নিয়েও সাগর-রুনি খুনের মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন জমা না দেওয়ার ঘটনা ‘নজিরবিহীন’ বলে মন্তব্য করেন সিনিয়র সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ১০০তম বার সময় নিয়েও যখন সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির খুনের মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা পড়ে না; প্রকৃত খুনি শনাক্ত হয় না, তখন সাংবাদিক সমাজ ব্যথিত, বিস্মিত। অথচ ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনি ধরার অঙ্গীকার করেছিলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। বাস্তবিক অর্থে বাংলাদেশে কোনো সাংবাদিক হত্যার সুষ্ঠু বিচার হয়নি। অথচ রাষ্ট্রের দায়িত্ব, সাংবাদিক খুনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা যত প্রভাবশালী হোক না কেন, তাদের গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করে শাস্তি নিশ্চিত করা। কিন্তু আমাদের দেশে সেটি হচ্ছে না। ফলে সাংবাদিক খুন করেও বিচারের বাইরে থেকে যাচ্ছেন খুনিরা।
এখন পর্যন্ত এই জোড়া খুনের ঘটনায় আটজন গ্রেপ্তার হন। এর মধ্যে ছয়জন কারাগারে রয়েছেন। ছয়জন তদন্ত কর্মকর্তা মামলাটি তদন্ত করেছেন।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক মো. নূর খান প্রথম আলোকে বলেন, সাংবাদিক সাগর-রুনির খুনের মামলাটি যতটা গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করে খুনিদের শনাক্ত করা উচিত ছিল, তার কোনোটিই হয়নি।
বরং সন্দেহের ভিত্তিতে যাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তাঁদের কয়েকজন জেল খাটছেন বছরের পর বছর।
অথচ সাড়ে ১১ বছরেও ১০০তম বার সময় নিয়েও র্যাব আদালতে প্রতিবেদন জমা দিতে পারল না। এর মধ্য দিয়ে সাংবাদিক খুনের বিচারহীনতার আরেকটি নজির স্থাপিত হচ্ছে।