ক্যাসিনো–কাণ্ডের শেষ আসামি আরমান ৫ দিন আগেই ছাড়া পেয়েছেন

এনামুল হক ওরফে আরমান
ফাইল ছবি

ক্যাসিনো–কাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে থাকা ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সাবেক সহসভাপতি এনামুল হক ওরফে আরমানও জামিনে ছাড়া পেয়েছেন। তাঁর মুক্তির মধ্য দিয়ে ক্যাসিনো–কাণ্ডের সব আসামি একে একে জামিনে ছাড়া পেয়ে গেলেন।

এর আগে জামিনে ছাড়া পেয়েছেন ক্যাসিনো–কাণ্ডের আসামি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাট, বহিষ্কৃত নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ও মমিনুল হক ওরফে সাঈদ। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁরা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে সহযোগীদের দিয়ে ঢাকার ক্লাবগুলোয় ক্যাসিনো–জুয়ার আসর বসান। পাশাপাশি চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ বিদেশে পাচার করেন।

গাজীপুরের কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ কারা তত্ত্বাবধায়ক সুব্রত কুমার বালা আজ বৃহস্পতিবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, সব মামলায় জামিনের কাগজপত্র পর্যালোচনা করে ১৮ মার্চ এনামুল হককে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

এনামুল হক ওরফে আরমান ক্যাসিনো সম্রাটখ্যাত ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাটের সহযোগী ও ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ক্যাসিনো–কাণ্ডে গ্রেপ্তার হওয়ার পর যুবলীগ দুজনকেই বহিষ্কার করে। মুক্তি পাওয়ার আগপর্যন্ত এনামুল কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারে ছিলেন।

এনামুল হক ওরফে আরমান ক্যাসিনো সম্রাটখ্যাত ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাটের সহযোগী ও ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ক্যাসিনো–কাণ্ডে গ্রেপ্তার হওয়ার পর যুবলীগ দুজনকেই বহিষ্কার করে। মুক্তি পাওয়ার আগপর্যন্ত এনামুল কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে ছিলেন।

সব মামলায় জামিনের কাগজপত্র পর্যালোচনা করে ১৮ মার্চ এনামুল হককে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
সুব্রত কুমার বালা, কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ কারা তত্ত্বাবধায়ক

যুবলীগের একাধিক সূত্র জানায়, এনামুলের উত্থানের পেছনে ভূমিকা রেখেছেন যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন। দুজনের বাড়ি ফেনীতে। একই জেলায় বাড়ি বলে সম্রাটের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ ছিল এনামুলের। সেই সুবাদেই ২০১৩ সালে যুবলীগের মহানগর দক্ষিণের সহসভাপতির পদ পান এনামুল। সম্রাটের ছত্রচ্ছায়ায় ক্লাবপাড়ার ক্যাসিনো ও জুয়া-বাণিজ্যের অন্যতম নিয়ন্ত্রকে পরিণত হন তিনি।

ছাড়া পেয়ে হাজিরাও দিলেন এনামুল

ঢাকার আদালত সূত্রগুলো বলছে, ক্যাসিনো–কাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে সাড়ে তিন বছর আগে গ্রেপ্তার হওয়া এনামুলের বিরুদ্ধে চারটি মামলা হয়। র‌্যাবের পক্ষ থেকে তাঁর বিরুদ্ধে মাদক ও অস্ত্র আইনে মামলা হয়। পরে তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) পৃথক দুই মামলা করে।

চারটি মামলাতেই এনামুলের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা পড়েছে। জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও মানি লন্ডারিংয়ের দুটি মামলায় তাঁর বিচারও শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে তাঁর বিরুদ্ধে কয়েকজন সাক্ষ্য দিয়েছেন। আর মাদক ও অস্ত্র আইনের মামলা দুটি অভিযোগ গঠনের শুনানির পর্যায়ে রয়েছে।

মামলার নথিপত্র সূত্রে ও আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এনামুল হক সবশেষে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকের মামলায় ঢাকার বিশেষ জজ আদালত–৯ থেকে ১৬ মার্চ জামিন পান। জামিনের বিষয়ে দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) রফিকুল হক প্রথম আলোকে বলেন, এই মামলায় এনামুল জামিন পান। দুদকের পক্ষে তিনি এই জামিনের বিরোধিতা করে বক্তব্য উপস্থাপন করেছিলেন।

এনামুল হক ওরফে আরমান

এনামুলের জামিনের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে তাঁর আইনজীবীরা আদালতকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে তিনি জেলহাজতে রয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই।

মানি লন্ডারিংয়ের আরেকটি মামলায় আজ ঢাকার বিভাগীয় স্পেশাল জজ আদালতে শুনানির দিন ধার্য ছিল। তিনি আদালতে হাজির হয়ে জামিন স্থায়ী করার আবেদন করেন। আদালতের বেঞ্চ সহকারী আরিফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, জামিনে ছাড়া পাওয়ার পর এ প্রথমবারের মতো আসামি এনামুল হক আদালতে হাজির হন।

সিআইডির করা মানি লন্ডারিংয়ের ওই মামলায় ৬ মার্চ জামিন পান এনামুল হক। এ বিষয়ে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আবদুল্লাহ আবু প্রথম আলোকে বলেন, এনামুল হকের জামিনের বিরোধিতা করে তিনি বক্তব্য উপস্থাপন করেছিলেন।

২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর সম্রাট ও তাঁর সহযোগী তৎকালীন যুবলীগ নেতা এনামুলকে কুমিল্লা থেকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। তখন র‍্যাব জানিয়েছিল, গ্রেপ্তারের সময় সম্রাট ও এনামুল মদ্যপ অবস্থায় ছিলেন। তাঁদের কাছে বিদেশি মদ ছিল। এ কারণে ভ্রাম্যমাণ আদালত তাঁদের ছয় মাসের কারাদণ্ড দেন।

গ্রেপ্তার করার পর সম্রাট ও এনামুলকে কুমিল্লা থেকে ঢাকায় আনা হয়। সম্রাটকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর কাকরাইলের কার্যালয়ে অভিযান চালায় র‍্যাব। এ সময় কার্যালয়ে বন্য প্রাণীর চামড়া, মাদকদ্রব্য ও অস্ত্র পাওয়ার কথা জানানো হয়। বন্য প্রাণীর চামড়া রাখায় ভ্রাম্যমাণ আদালত তাঁকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেন।

এনামুল হকের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ

২০১৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর মাদক মামলায় সম্রাট ও এনামুলের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় র‌্যাব। অভিযোগপত্রে বলা হয়, সম্রাট জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছিলেন, তাঁর সহযোগী এনামুলের সহযোগিতায় তিনি মাদকদ্রব্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতেন। তাঁদের কাছ থেকে উদ্ধার করা মাদকদ্রব্যের কোনো বৈধ কাগজপত্র তাঁরা দেখাতে পারেননি।

ঢাকার দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি হিসেবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাজধানীর বিভিন্ন ক্লাব পরিচালনা করতেন সম্রাট। তাঁর নিয়ন্ত্রণেই এসব ক্লাবে ক্যাসিনোসহ জুয়ার আসর বসত। এভাবে বিপুল অর্থসম্পদের মালিক হন তিনি। প্রতি মাসে ক্যাসিনো খেলার জন্য তিনি সিঙ্গাপুরেও যেতেন। করতেন সরকারি ও বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি। এনামুল ছাড়াও তাঁর সহযোগী ছিলেন সাবেক কাউন্সিলর ও বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা মমিনুল হক ওরফে সাঈদ এবং খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া।

ক্যাসিনো ব্যবসার মাধ্যমে অবৈধ অর্থ উপার্জনের অভিযোগে করা মানি লন্ডারিংয়ের মামলায় ২০২১ সালের ২১ নভেম্বর এনামুল, মমিনুলসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত।

মানি লন্ডারিংয়ের মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়, মমিনুল হক দলের প্রভাব খাটিয়ে মোহামেডান ক্লাবে ক্যাসিনো ব্যবসা পরিচালনা করতেন। সাঈদের বন্ধু আবুল কাশেম প্রতিদিন পাঁচ লাখ টাকা দেওয়ার বিনিময়ে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব হলরুম ভাড়া নেন। আর এনামুল হকও এতে জড়িত ছিলেন। তিনি আদালতে ১৬৪ ধারায় এ মামলায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের মামলায় গত বছরের মে মাসে দুদক আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয়। এই অভিযোগপত্রের তথ্য বলছে, এনামুল অবৈধ পন্থায় জ্ঞাত আয়ের বাইরে অসংগতিপূর্ণ ১২ কোটি ৪২ লাখ ৫৪ হাজার ৪২৮ টাকার অস্থাবর সম্পদ অর্জন করেন। এর মধ্যে ৬ কোটি ৫৬ লাখ ২৫ হাজার ৩৭৯ টাকা সিঙ্গাপুরে পাচার করেছেন।

তবে প্রতিটি মামলায় এনামুলের আইনজীবীরা আদালতে লিখিতভাবে দাবি করেন, রাজনৈতিকভাবে হয়রানি করার জন্য এসব মামলা দেওয়া হয়েছে। তিনি বিদেশে কোনো টাকা পাচার করেননি। কোনো ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নন।