‘কিশোর গ্যাং’ প্রশ্রয় দেন ঢাকার ২১ কাউন্সিলর

নাম কিশোর গ্যাং হলেও এসব বাহিনীর সদস্যরা বেশির ভাগই ১৮ বছরের বেশি বয়সী।রাজধানীতে অপরাধে জড়িত তাঁরা। 

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান এলাকায় বছর সাতেক আগে ১১ জন ব্যক্তি মিলে ৪ শতাংশ জমি কেনেন। তিন মাস আগে সেই জমিতে ভবন নির্মাণ করতে গেলে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন স্থানীয় ‘গাংচিল বাহিনী’র সদস্যরা। জমির মালিকেরা পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দিয়ে ভবনের নির্মাণকাজ শুরু করতে পেরেছেন।

মালিকদের একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, চাঁদার টাকা দিতে একটু দেরি হয়েছিল। সে কারণে নির্মাণশ্রমিকদের মারধর করা হয়েছিল। গাংচিল বাহিনীকে চাঁদা না দিয়ে ওই এলাকায় কোনো ভবন নির্মাণ করা যায় না।

এলাকাবাসী ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গাংচিল বাহিনীর নেতা মো. মোশারফ হোসেন ওরফে লম্বু মোশারফ পুলিশের তালিকাভুক্ত অপরাধী। তাঁর বিরুদ্ধে অন্তত ১৫টি মামলা রয়েছে। তাঁকে ও তাঁর বাহিনীকে প্রশ্রয় দেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আসিফ আহমেদ।

আসিফ আহমেদ গত ২১ জানুয়ারি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার সঙ্গে কোনো অপরাধীর সখ্য নেই। আমি চার বছর হলো রাজনীতিতে এসেছি। এসব অপরাধী আগে থেকেই এলাকায় ছিল।’

অবশ্য এলাকাবাসী বলছেন, আসিফ কাউন্সিলর হয়ে অপরাধীদের বিরুদ্ধে অবস্থান না নিয়ে বরং তাদের প্রশ্রয় দেওয়া শুরু করেন। গাংচিল বাহিনীর সদস্যরা আসিফের সভা ও মিছিলে অংশ নেন। মোশারফের পাশে বসা অবস্থায় আসিফের ছবিও রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মোশাররফ যুবলীগের পদ পাওয়ার চেষ্টায় আছেন।

প্রথম আলোর অনুসন্ধান ও পুলিশের নিজস্ব প্রতিবেদন সূত্রে ঢাকায় গাংচিল বাহিনীর মতো অন্তত ৮০টি বাহিনীর খোঁজ পাওয়া গেছে, যেগুলোর বেশির ভাগ ‘কিশোর গ্যাং’ নামে পরিচিত। নামে কিশোর গ্যাং হলেও এসব বাহিনীর বেশির ভাগ সদস্যের বয়স ১৮ বছরের বেশি। তাঁরা ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, জমি দখলে সহায়তা, ইন্টারনেট সংযোগ, কেব্‌ল টিভি (ডিশ) ব্যবসা ও ময়লা–বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ, উত্ত্যক্ত করা, যৌন হয়রানি করা, হামলা, মারধরসহ নানা অপরাধে জড়িত।

গাংচিল বাহিনীর সদস্যরা আসিফের সভা ও মিছিলে অংশ নেন। মোশারফের পাশে বসা অবস্থায় আসিফের ছবিও রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মোশাররফ যুবলীগের পদ পাওয়ার চেষ্টায় আছেন।

বাহিনীগুলোর নেতাদের কেউ কেউ সরাসরি ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতি করেন। কেউ কেউ রাজনীতিতে যুক্ত না থাকলেও আশ্রয় পান রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে। পুলিশের একটি প্রতিবেদনে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের অন্তত ২১ জন কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে ‘গ্যাং’ প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ এসেছে।

সারা দেশের ‘কিশোর গ্যাং’ নিয়ে পুলিশ প্রতিবেদন তৈরি করেছিল ২০২২ সালের শেষ দিকে। এতে বলা হয়েছে, সারা দেশে অন্তত ১৭৩টি কিশোর গ্যাং রয়েছে। বিভিন্ন অপরাধে এদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ৭৮০টি। এসব মামলায় আসামি প্রায় ৯০০ জন। রাজধানীতে কিশোর গ্যাং রয়েছে ৬৬টি। চট্টগ্রাম শহরে আছে ৫৭টি। মহানগরের বাইরে ঢাকা বিভাগে রয়েছে ২৪টি গ্যাং। বেশির ভাগ বাহিনীর সদস্য ১০ থেকে ৫০ জন।

ঢাকায় অনুসন্ধান চালিয়ে ও পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পুলিশের প্রতিবেদনে যে চিত্র উঠে এসেছিল, তার চেয়ে এখন পরিস্থিতি খারাপ। যেমন পুলিশের তালিকার বাইরে ঢাকায় আরও অন্তত ১৪টি কিশোর গ্যাংয়ের খোঁজ পাওয়া গেছে।

ডিএমপি সূত্র বলছে, ২০২৩ সালে রাজধানীতে যত খুন হয়েছে তার ২৫টির কিশোর গ্যাং সংশ্লিষ্ট।

বাহিনীগুলো শুধু অপরাধই করে না, আধিপত্য বজায় রাখতে পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষেও জড়ায়। ডিএমপি সূত্র বলছে, ২০২৩ সালে রাজধানীতে যত খুন হয়েছে তার ২৫টির কিশোর গ্যাং সংশ্লিষ্ট।

কিশোর গ্যাং নতুন করে আলোচনায় এসেছে ৯ ফেব্রুয়ারি মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগরে একটি খুনের ঘটনায়। ওই দিন ছাত্রীদের উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করার জেরে নীরব হোসেন (১৭) নামের এক এসএসসি পরীক্ষার্থীকে ছুরিকাঘাত করে খুন করেন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা।

এর আগে ৩ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়ায় পদ্মা নদীর চর থেকে মিলন হোসেন (২৭) নামের যুবকের ৯ টুকরা লাশ উদ্ধার করা হয়। হত্যার ঘটনায় জড়িত সন্দেহে গ্রেপ্তার হন জেলা ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত সহসভাপতি এস কে সজীব। পুলিশ বলছে, তিনি একটি কিশোর গ্যাংয়ের নেতা।

ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় একসময় শীর্ষ সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন বাহিনীর নেতৃত্ব দিতেন। এখন ক্ষমতাসীন দল এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কোনো কোনো নেতার নাম আসছে। অপরাধী বাহিনীর রাজনৈতিক সংযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমান ৯ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোকে বলেন, ‘যারা কিশোর গ্যাংয়ের নামে অপরাধ কার্যক্রম চালায়, তাদেরকে আমরা সন্ত্রাসী বলব। সন্ত্রাসীদের কোনো নির্দিষ্ট দল নেই।’ তিনি বলেন, ‘অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িত সন্ত্রাসীরা যে–ই হোক না কেন, আমরা তাদের শক্ত হাতে দমন করছি, ভবিষ্যতেও করব।’

অবশ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাহিনীগুলো একদিনে গড়ে ওঠেনি। রাজনীতিবিদদের প্রশ্রয় ও পুলিশের নিষ্ক্রিয়তায় এসব বাহিনী এখন ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। রাজধানীতে, বড় শহরে মানুষের নিরাপদ বসবাসের ক্ষেত্রে বড় হুমকি হয়ে উঠেছে এসব বাহিনী।

যারা কিশোর গ্যাংয়ের নামে অপরাধ কার্যক্রম চালায়, তাদেরকে আমরা সন্ত্রাসী বলব। সন্ত্রাসীদের কোনো নির্দিষ্ট দল নেই।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমান

২১ কাউন্সিলরের নাম

পুলিশের প্রতিবেদনে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জহিরুল ইসলাম (মানিক), ৫ নম্বরের আবদুর রউফ, ৬ নম্বরের তাইজুল ইসলাম চৌধুরী, ৭ নম্বরের তফাজ্জল হোসেন, ৯ নম্বরের মজিব সরোয়ার (মাসুম), ৩০ নম্বরের আবুল কাশেম, ৩১ নম্বরের শফিকুল ইসলাম (সেন্টু) ও ৩৪ নম্বরের শেখ মোহাম্মদ হোসেনের নাম এসেছে কিশোর গ্যাংয়ের আশ্রয়দাতা হিসেবে।

একই অভিযোগে পুলিশের প্রতিবেদনে নাম এসেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রফিকুল ইসলাম (বাবলা), ৩১ নম্বরের শেখ মোহাম্মদ আলমগীর, ৩৩ নম্বরের মো. আউয়াল হোসেন, ৩৮ নম্বরের আহমেদ ইমতিয়াজ মন্নাফী, ৪৬ নম্বরের মো. শহিদ উল্লাহ, ৪৮ নম্বর ওয়ার্ডের আবুল কালাম (অনু), ৫০ নম্বরের মাসুম মোল্লা, ৬১ নম্বরের জুম্মন মিয়া, ৬২ নম্বরের মোহাম্মদ মোস্তাক আহমেদ, ৬৭ নম্বরের মো. ইবরাহীম, ৬৮ নম্বরের মাহমুদুল হাসান (পলিন), ৬৯ নম্বরের সালাহ্‌উদ্দিন আহম্মেদ ও ৭০ নম্বরের মোহাম্মদ আতিকুর রহমানের।

পুলিশের প্রতিবেদনে নাম আসা ১০ জন কাউন্সিলরের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। পাঁচজন বলেছেন, তাঁদের এলাকায় ‘কিশোর গ্যাং’ই নেই। বাকিরা প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। যেমন উত্তর সিটির ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আবদুর রউফ ৯ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ২০ বছর ধরে এলাকার কাউন্সিলর। কারা অপরাধীদের প্রশ্রয়দাতাদের তালিকায় আমার নাম দিলেন, সেটা আমার জানা নেই।’

অবশ্য এলাকাবাসীর কেউ কেউ বলছেন, কাউন্সিলররাই এখন এলাকার সর্বেসর্বা। তাঁরা প্রশ্রয় না দিলে তাঁদের এলাকায় বাহিনী পরিচালনা অসম্ভব।

মোহাম্মদপুর থানা ছাত্রলীগের দায়িত্বশীল এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বিস্তারের জন্য কাউন্সিলর, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাদের কেউ কেউ অপরাধী চক্রগুলোকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেন। তিনি বলেন, ঢাকায় কাউন্সিলর হতে এখন অনেক টাকা খরচ। চাঁদাবাজি, ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, দরপত্র নিয়ন্ত্রণ ও মাদক ব্যবসার ভাগ নেন কোনো কোনো কাউন্সিলর।

আমি ২০ বছর ধরে এলাকার কাউন্সিলর। কারা অপরাধীদের প্রশ্রয়দাতাদের তালিকায় আমার নাম দিলেন, সেটা আমার জানা নেই।
উত্তর সিটির ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আবদুর রউফ

‘গ্যাং’ বেশি মিরপুরে

ডিএমপির আটটি বিভাগের মধ্যে যেসব এলাকায় স্বল্প আয়ের মানুষের বসবাস বেশি, সেখানেই গ্যাং বেশি। এর একটি মিরপুর। ডিএমপির মিরপুর বিভাগের সাতটি থানা এলাকায় সক্রিয় ১৬টি বাহিনী।

সবচেয়ে বড় গ্যাং রয়েছে স্বেচ্ছাসেবক লীগের জাতীয় কমিটির সদস্য নাবিল খানের। পুলিশ বলছে, তাঁর গ্যাংয়ের সদস্যরা নানা অপরাধে জড়িত। মিরপুর মাজার রোড থেকে গাবতলী বাস টার্মিনাল পর্যন্ত দোকানপাট, কারখানা, রিকশা গ্যারেজ ও বিভিন্ন যানবাহন থেকে চাঁদা তোলেন নাবিল খান ও তাঁর বিরোধী পক্ষ ইসলাম বাহিনীর সদস্যরা। এই চাঁদাবাজির একক নিয়ন্ত্রণ নিতেই গত অক্টোবরে শাহ আলম নামে নাবিলের এক অনুসারীকে মারধর করা হয়। পরে তাঁর মৃত্যু হয়।

নাবিল খান প্রথম আলোকে বলেন, অপরাধ করে অনেকে তাঁর লোক বলে পরিচয় দেন। অপরাধীদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নেই।

মিরপুর মাজার রোড থেকে গাবতলী বাস টার্মিনাল পর্যন্ত দোকানপাট, কারখানা, রিকশা গ্যারেজ ও বিভিন্ন যানবাহন থেকে চাঁদা তোলেন নাবিল খান ও তাঁর বিরোধী পক্ষ ইসলাম বাহিনীর সদস্যরা। এই চাঁদাবাজির একক নিয়ন্ত্রণ নিতেই গত অক্টোবরে শাহ আলম নামে নাবিলের এক অনুসারীকে মারধর করা হয়। পরে তাঁর মৃত্যু হয়।

অবশ্য মিরপুরে সংশ্লিষ্ট এলাকার কেব্‌ল টিভির (ডিশ) সংযোগদাতা, ইন্টারনেট, তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) বিক্রেতা এবং ফুটপাতের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বলছেন, নাবিলের বাহিনীকে চাঁদা না দিয়ে ব্যবসা করা কঠিন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে মিরপুরের এক ইন্টারনেট ব্যবসায়ী প্রথম আলোকে বলেন, আগে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের চাঁদা দিতে হতো। এখন দিতে হয় স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতার বাহিনীকে। চাঁদা না পেলে বাহিনী পাঠিয়ে দোকানে ভাঙচুর করা হয়। গত ৮ জানুয়ারি মিরপুরের মাজার রোড এলাকার আয়েশা সুপার মার্কেটে হামলা করেছিল নাবিলের সহযোগী শফিকুল রহমানের (অতুল) লোকজন।

নাবিলের বাহিনী ছাড়া মিরপুরে ১৩টির মতো গ্যাং রয়েছে। যাদের নাম ভাস্কর বাহিনী, রিংকু বাহিনী, আশিক বাহিনী, পটেটো বাবু বাহিনী, ডিজে রোমান বাহিনী, ম্যাক্স পলু বাহিনী, রুবেল বাহিনী, অনিক বাহিনী, পারভেজ বাহিনী, মিলন বাহিনী, বাট্টু বাহিনী, বাবলা বাহিনী, শরিফ ওরফে ডাসা বাহিনী।

বাহিনীগুলোর বিষয়ে অনুসন্ধানকালে গত ২০ জানুয়ারি পল্লবীর কালশীতে যান এই প্রতিবেদক। ওই দিন সন্ধ্যায় আশিক বাহিনীর সদস্যরা ম্যাক্স পলুর ওপর হামলা করে তাঁকে বেধড়ক মারধর করেন। পরে পলু প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি আগে নানা অপরাধে জড়িত ছিলাম। এখন ভালো হয়ে এলাকার একটি মোটরসাইকেল মেরামতের দোকানে কাজ করি। কী কারণে তারা আমার ওপর হামলা করল বুঝতে পারছি না।’

অবশ্য স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য ভিন্ন। তাঁরা বলছেন, মুঠোফোন ছিনতাই নিয়ে বিরোধে এক পক্ষ অন্য পক্ষের ওপর হামলা করেছে।

মিরপুরে আরেকটি বাহিনীর নাম ভাস্কর বাহিনী। সাঈদ ইকবাল ভাস্কর এই বাহিনীর প্রধান। তিনি মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধে জড়িত। তাঁর বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলা রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, সাঈদ এসব অপরাধ করেন তাঁর মামা মিরপুর থানা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আনোয়ার হোসেনের আশ্রয়ে।

নাবিলের বাহিনী ছাড়া মিরপুরে ১৩টির মতো গ্যাং রয়েছে। যাদের নাম ভাস্কর বাহিনী, রিংকু বাহিনী, আশিক বাহিনী, পটেটো বাবু বাহিনী, ডিজে রোমান বাহিনী, ম্যাক্স পলু বাহিনী, রুবেল বাহিনী, অনিক বাহিনী, পারভেজ বাহিনী, মিলন বাহিনী, বাট্টু বাহিনী, বাবলা বাহিনী, শরিফ ওরফে ডাসা বাহিনী।

অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে আনোয়ার হোসেনের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হয়। খুদে বার্তা পাঠানো হয়। কিন্তু সাড়া পাওয়া যায়নি। সাঈদের বিরুদ্ধে মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট এক পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, সাঈদ কোনো অপরাধ করেই তাঁর মামা আনোয়ার হোসেনের বাসায় আশ্রয় নেন।

মিরপুর মডেল থানার লাভ রোড এলাকায় ছক্কা রেস্টুরেন্ট নামের একটি খাবারের দোকান রয়েছে। দোকানটির মালিক বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের একজন খেলোয়াড়। দোকানের বর্ধিতাংশ জাহাজের কনটেইনার দিয়ে তৈরি। গত বছর ৪ মার্চ কনটেইনারটি চুরি করে ধানমন্ডিতে নিয়ে যান রিংকু বাহিনীর সদস্যরা। মিরপুর থানায় এ নিয়ে মামলা হয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে দিনদুপুরে খাবারের দোকানটিতে ভাঙচুর চালান রিংকু বাহিনী।

অনুসন্ধানে জানা যায়, রিংকু বাহিনীর প্রধান রিপন মাহমুদ ওরফে রিংকু। তাঁর বিরুদ্ধে মিরপুর মডেল থানায় একাধিক মামলা রয়েছে।

মোহাম্মপুরে দিনদুপুরে সন্ত্রাস

মোহাম্মদপুরে সক্রিয় অন্তত ১১টি বাহিনী। গাংচিল ছাড়াও রয়েছে কবজি কাটা গ্রুপ, বিরিয়ানি সুমন গ্রুপ, শুটার আনোয়ার গ্রুপ, আকাশ গ্রুপ, লও ঠেলা, দে ধাক্কা, এলেক্স সুমন, লাল বাহিনী ও লাড়া দে নামের অপরাধী চক্র।

ইন্টারনেটে খোঁজ করলেই এসব বাহিনীর সন্ত্রাসী কার্যকলাপের ভিডিও সামনে আসে। মাস পাঁচেক আগে র‍্যাবের দেওয়া একটি ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, এক তরুণকে দিবালোকে রাস্তায় ফেলে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপাচ্ছেন ‘কবজি কাটা বাহিনী’র সদস্যরা।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, প্রায়ই বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা ধারালো অস্ত্র নিয়ে রাস্তায় মারামারি লিপ্ত হন, হামলা করেন। এতে এলাকায় আতঙ্ক তৈরি হয়। মোহাম্মদপুরের রিং রোডের একজন বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ক্যাম্প বাজার থেকে একদল তরুণ মাঝেমধ্যে বেরিয়ে কোনো না কোনো দোকানদারের সঙ্গে ঝগড়া বাধান। এরপর ভাঙচুর করেন। এই সুযোগে দোকানে দোকানে লুটপাট করেন।

মোহাম্মদপুরে সক্রিয় অন্তত ১১টি বাহিনী। গাংচিল ছাড়াও রয়েছে কবজি কাটা গ্রুপ, বিরিয়ানি সুমন গ্রুপ, শুটার আনোয়ার গ্রুপ, আকাশ গ্রুপ, লও ঠেলা, দে ধাক্কা, এলেক্স সুমন, লাল বাহিনী ও লাড়া দে নামের অপরাধী চক্র।

মোহাম্মদপুর থানা ছাত্রলীগের সহসভাপতি সাজ্জাদ রহমানের নেতৃত্বে চলে একটি অপরাধী চক্র। তারা ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। গত ডিসেম্বরে সংগঠনবিরোধী কর্মকাণ্ড ও অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে তাঁকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়। সাজ্জাদ এখন আত্মগোপনে রয়েছেন।

মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ ও আশপাশের এলাকায় ৪০টির মতো নির্মাণসামগ্রী বিক্রির দোকান রয়েছে। স মিল (কাঠ কাটার কারখানা) রয়েছে অনেক। আটজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সবাইকে মাসে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা করে চাঁদা দিতে হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে নির্মাণসামগ্রী ব্যবসায়ী এক যুবলীগ নেতা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁকে মাসে ১০ হাজার টাকা করে চাঁদা দিতে বলা হয়েছে। নইলে ব্যবসা করতে দেওয়া হবে না বলে হুমকি দিয়েছে।

ডেমরা–সূত্রাপুরে ১৭টি বাহিনী

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র বলছে, ডিএমপির ওয়ারী বিভাগের ডেমরা ও সূত্রাপুর অঞ্চলে বাহিনী রয়েছে ১৭টি।

যাত্রাবাড়ী এলাকায় প্রায় ২৫ সদস্যের একটি বাহিনী গড়ে তুলেছেন কামরুল হাসান ওরফে পলাশ (৩২)। তাঁর বাহিনীর নাম কামরুল বাহিনী। কামরুল নিজেকে যুবলীগ নেতা পরিচয় দেন। অভিযোগ রয়েছে, তাঁদের প্রশ্রয় দেন দক্ষিণ সিটির ৬১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর জুম্মন মিয়া। চক্রটি মাদক ব্যবসা, চুরি, ছিনতাই ও চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত।

অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে কামরুলের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে কাউন্সিলর জুম্মন মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, তিনি বিএনপির রাজনীতি করেন। বেশির ভাগ সময় তাঁকে পালিয়ে থাকতে হয়। তবে কামরুল বাহিনীর কামরুলকে চেনেন। কামরুল যুবলীগ করেন।

যাত্রাবাড়ী এলাকায় প্রায় ২৫ সদস্যের একটি বাহিনী গড়ে তুলেছেন কামরুল হাসান ওরফে পলাশ (৩২)। তাঁর বাহিনীর নাম কামরুল বাহিনী। কামরুল নিজেকে যুবলীগ নেতা পরিচয় দেন। অভিযোগ রয়েছে, তাঁদের প্রশ্রয় দেন দক্ষিণ সিটির ৬১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর জুম্মন মিয়া।

ডেমরায় লিটন বাহিনী, মুক্তার বাহিনী, নাসির বাহিনী, জুয়েল বাহিনী, প্রকাশ বাহিনী, আলামিন বাহিনী, সাঈদ বাহিনী, শান্ত বাহিনী, ভাগনে সুমন বাহিনী ও আরিফ বাহিনী সক্রিয় বলে জানিয়েছে পুলিশ ও এলাকাবাসী সূত্র।

পুরান ঢাকার বিবির বাগিচা এলাকায় ‘আতঙ্কের’ নাম জুয়েল বাহিনী। এটিসহ তিনটি বাহিনীকে প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে দক্ষিণ সিটির ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আহমেদ ইমতিয়াজ মন্নাফীর বিরুদ্ধে। তিনি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহম্মেদ মন্নাফীর ছেলে। অভিযোগের বিষয়ে ৯ ফেব্রুয়ারি বক্তব্য জানতে চাইলে ইমতিয়াজ মন্নাফী বলেন, তিনি হাসপাতালে। পরে ফোন করে তাঁকে আর পাওয়া যায়নি।

ডেমরায় লিটন বাহিনী, মুক্তার বাহিনী, নাসির বাহিনী, জুয়েল বাহিনী, প্রকাশ বাহিনী, আলামিন বাহিনী, সাঈদ বাহিনী, শান্ত বাহিনী, ভাগনে সুমন বাহিনী ও আরিফ বাহিনী সক্রিয় বলে জানিয়েছে পুলিশ ও এলাকাবাসী সূত্র।

‘নিয়ন্ত্রণকারীরাই অপরাধ সৃষ্টিতে’

সমাজবিজ্ঞানী, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য ও পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কিশোরদের মধ্যে জ্যেষ্ঠতার (সিনিয়র–জুনিয়র) দ্বন্দ্ব নিয়ে প্রথম বিরোধ ও জোট বাঁধার প্রবণতা তৈরি হয়। সেখান থেকে গড়ে ওঠে গ্যাং। তাদের প্রশয় দেন এলাকার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত বড় ভাইয়েরা।

সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, সমাজে শৃঙ্খলা রক্ষায় পরিবার ও স্থানীয় মুরব্বিদের ভূমিকা ছিল। তাঁরা কিশোরদের বখাটেপনার প্রশ্রয় দিতেন না। এখন মুরব্বিদের জায়গাটি নিয়েছেন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা। তাঁরা কিশোরদের ব্যবহার করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, রাজধানীসহ দেশের বড় ও বাণিজ্যিক শহরগুলোতে কিশোর অপরাধ ও গ্যাং সংস্কৃতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। রাজনীতিবিদ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে কেউ কেউ এই অপরাধীদের প্রশ্রয়দাতা হিসেবে কাজ করছেন। তিনি বলেন, মোদ্দাকথা হলো যাঁরা অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করবেন, তাঁদের মধ্যে একটি বড় অংশ অপরাধ সৃষ্টির অংশ হিসেবে কাজ করছেন। সেখান থেকে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন।