১৫ মাসেও ভারত থেকে আনা গেল না পুলিশ পরিদর্শক সোহেল রানাকে

সোহেল রানা
ছবি: সংগৃহীত

ভারতে গ্রেপ্তার ঢাকার বনানী থানার সাবেক পরিদর্শক (তদন্ত) শেখ সোহেল রানাকে ১৫ মাসেও দেশে ফেরত আনা যায়নি। শুরুতে পুলিশ তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনতে তৎপর ছিল। এ নিয়ে গত বছরের মে মাস পর্যন্ত পুলিশ সদর দপ্তর ভারতের সংশ্লিষ্ট সংস্থার সঙ্গে চিঠি চালাচালি করে।

এখন সবই থেমে আছে। পুলিশের তদন্ত–সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও সোহেল রানাকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে কিছু বলতে পারছেন না।

ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জের ‘প্রতারণা’র বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর সোহেল ভারতে পালিয়ে যান। ২০২১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তিনি ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) হাতে পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারে গ্রেপ্তার হন। সোহেল এখন কোচবিহারের একটি কারাগারে।

প্রতারণার ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর সোহেল রানাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তিনি নেপথ্যে থেকে ই-অরেঞ্জ নামের প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

বিদেশ থেকে অপরাধী ফিরিয়ে আনা, অন্য দেশের সঙ্গে যোগাযোগ, আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে সমন্বয়ের দায়িত্ব পুলিশের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরোর (এনসিবি)। এনসিবির সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) শরীফ মোস্তাফিজুর রহমানের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে গত ২৭ ডিসেম্বর তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সোহেলকে দেশে ফেরত আনার বিষয়ে তাঁর কিছু জানা নেই। তিনি পুলিশ সপ্তাহ (৩ থেকে ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত) নিয়ে ব্যস্ত। ব্যস্ততা কমলে খোঁজ নিয়ে জানাতে পারবেন।

থেমে আছে দেশে ফেরানোর উদ্যোগ

সোহেল রানাকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে গত বছরের মে মাস পর্যন্ত পুলিশ সদর দপ্তরের এনসিবি ভারতের এনসিবিকে আটবার চিঠি দিয়েছিল। ভারত এর মধ্যে দুবার চিঠির জবাবও দেয়। তারা জানিয়েছিল, সোহেলের বিরুদ্ধে অনুপ্রবেশের দায়ে মামলার বিচার চলছে। এর বাইরে অন্য কোনো তথ্য তারা দেয়নি।

এনসিবির তৎকালীন এআইজি মহিউল ইসলাম পদোন্নতি পেয়ে এখন পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত ডিআইজি-প্রশিক্ষণ)। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে ৩১ ডিসেম্বর প্রথম আলোকে তিনি বলেন, তিন মাস আগে তিনি এনসিবি বিভাগ থেকে বদলি হয়েছেন। এনসিবির দায়িত্বে থাকাকালে সোহেলকে দেশে ফিরিয়ে আনতে তিনি ভারতের এনসিবির সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। বিষয়টি এখন কী অবস্থায় আছে, তা জানেন না।

২০২১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) হাতে পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারে গ্রেপ্তার হন সোহেল রানা। তিনি বর্তমানে সেখানকার একটি কারাগারে

২০২১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর তখনকার পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, সোহেল রানাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হবে। ভারতের সঙ্গে এ বিষয়ে অনানুষ্ঠানিকভাবে (আন–অফিশিয়ালি) কথাও হয়েছে। শিগগিরই অফিশিয়ালি কথা হবে। ভারতের সঙ্গে যেহেতু আমাদের আসামি প্রত্যর্পণ চুক্তি আছে, তাই তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনতে খুব একটা সমস্যা হবে না।

একই দিন তৎকালীন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলামও সোহেলকে দেশে ফিরিয়ে আনার কথা জানিয়ে বলেছিলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিএসএফকে চিঠি দিয়ে তাঁকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। অনেক সময় এটি করা হয়। তাঁরা তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। যদি এই মাধ্যমে ফিরিয়ে আনা সম্ভব না হয়, তাহলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তাঁকে ফেরত আনার চেষ্টা করা হবে।

ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জের ‘প্রতারণা’র বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর সোহেল ভারতে পালিয়ে যান। ২০২১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তিনি ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) হাতে পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারে গ্রেপ্তার হন।  সোহেল এখন কোচবিহারের একটি কারাগারে।

আইন বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, সোহেল রানার বিরুদ্ধে যেহেতু দেশে ফৌজদারি মামলা আছে, তাই তাঁকে ফিরিয়ে আনা জটিল কিছু হবে না। ভারত ও বাংলাদেশ দুই দেশের আইনে অনুপ্রবেশ একটি সুনির্দিষ্ট অপরাধ। সরকারের উচ্চপর্যায়ে আলাপ-আলোচনা করে বন্দিবিনিময় চুক্তির মাধ্যমে ফিরিয়ে এনে তাঁর বিচার করার সুযোগ আছে।

সম্পদ

পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর শাহজাদপুরে একটি, গুলশান মডেল টাউনে একটি, নিকেতনে দুটি ও বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ই–ব্লকে একটি ফ্ল্যাট আছে সোহেল রানার। গুলশানে একটি বাণিজ্যিক ভবনে ৯ কোটি টাকায় স্পেস (জায়গা) কিনেছেন তিনি। এ ছাড়া বসুন্ধরা ও পূর্বাচলে দুটি প্লট এবং গুলশান ও উত্তরায় তিনটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সন্ধান পাওয়া গেছে তাঁর। রাজধানীর বাইরে নিজ জেলা গোপালগঞ্জে এবং খাগড়াছড়িতে জমি কিনেছেন তিনি।

সোহেল রানার এই বিপুল অর্থসম্পদ নিয়ে পুলিশ অনুসন্ধান করার কথা জানিয়েছিল। কিন্তু পরে সেটা এগোয়নি। এ ছাড়া থাইল্যান্ডের পাতায়ায় সোহেল রানার সুপারশপ, জমি ও ফ্ল্যাট, পর্তুগালের লিসবনে সুপারশপ, বার ও রেস্তোরাঁ, ফিলিপাইনের ম্যানিলায় বার এবং নেপালের কাঠমান্ডুতে একটি বার ও ক্যাসিনো আছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। কোনো কোনো পুলিশ কর্মকর্তা মনে করেন, সোহেল রানা স্থলপথে ভারত হয়ে নেপাল যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন।

সোহেল রানা বছর ছয় আগে পদোন্নতি পেয়ে পুলিশের পরিদর্শক হন। এর আগে দীর্ঘদিন গুলশান ও বাড্ডা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ছিলেন। গুলশান বিভাগের পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সোহেল ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত গুলশান থানার এসআই থাকাকালে কূটনৈতিক এলাকার দায়িত্ব পালন করেন। তখন বিভিন্ন দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ গড়ে ওঠে। সোহেল বিভিন্ন দেশে লোক পাঠিয়েছেন বলেও তথ্য পেয়েছে পুলিশ।

গুলশানের পর সোহেল রানা ২০১৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত মালিবাগে পুলিশের বিশেষ শাখায় (এসবি) কর্মরত ছিলেন। পরে পদোন্নতি পেয়ে পরিদর্শক হলেও ২০২০ সালের ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত এসবিতে ছিলেন তিনি। এরপর চার মাস পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্র্যান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটে ছিলেন সোহেল। পরে ২০২০ সালের ২৮ মে বনানী থানায় পরিদর্শকের দায়িত্ব পান। দেশ ছাড়ার আগে ওই পদেই ছিলেন তিনি।

মামলা

গ্রাহকের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দেশের যেসব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, সেসবের একটি ই-অরেঞ্জ। ২০২১ সালের ১৮ আগস্ট ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে গুলশান থানায় মামলা হয়। এরপর সোহেল রানার নাম আলোচনায় আসে।

বর্তমানে সোহেল রানা, তাঁর কথিত স্ত্রী নাজনীন নাহার, বোন সোনিয়া মেহজাবিন ও ভগ্নিপতি মাশুকুর রহমানের নামে ৯টি মামলা আছে। এসব মামলায় প্রতারণা, অর্থ আত্মসাৎ, অর্থ পাচারসহ (মানি লন্ডারিং) বিভিন্ন অভিযোগ আনা হয়েছে। সোনিয়া ও মাশুকুর এখন কারাগারে আর নাজনীন পলাতক।

এসব মামলা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) তদন্ত করছে। চারটি মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, প্রতারণা করে গ্রাহকের বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে সোহেল রানা ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে সম্প্রতি চারটি মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে।

২০২১ সালের ১৮ আগস্ট ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে গুলশান থানায় মামলা হয়। এরপর সোহেল রানার নাম আলোচনায় আসে

সোহেল রানার বিরুদ্ধে হওয়া মানি লন্ডারিং আইনের মামলা তদন্ত করছেন সিআইডির পরিদর্শক মোহাম্মদ ছাদেক আলী। সোহেলকে ফেরত আনার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রথম আলোকে বলেন, তিনি এনসিবিকে চিঠি দিচ্ছেন। কিন্তু সোহেলকে ফেরত আনার অগ্রগতি সম্পর্কে জানেন না।

তবে মামলার অগ্রগতি প্রসঙ্গে ছাদেক আলী বলেন, সোহেলের বিষয়ে তথ্য চেয়ে ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে (বিএফআইইউ) চিঠি পাঠানো হয়েছে। সেই তথ্যও এসেছে। এখন পর্যন্ত সোহেলের বিরুদ্ধে ২৫০ কোটি টাকার অপরাধলব্ধ আয়ের প্রমাণ পাওয়া গেছে। মামলার তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে। শিগগিরই আদালতে এ মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।

প্রতারণা করে টাকা আত্মসাতের অভিযোগে অন্য চারটি মামলা তদন্ত করছে ডিএমপি। এসব মামলার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি বলে জানিয়েছেন ডিএমপির সংশ্লিষ্ট তদন্ত সম্পৃক্ত কর্মকর্তারা। তাঁরা বলেছেন, ভুক্তভোগী গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলা শেষ করে শিগগিরই অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।