চট্টগ্রাম বন্দর

সেই ২২ কনটেইনারে কী ছিল, এখনো অজানা

আমদানি করা ২২ কনটেইনার পণ্য চার বছর আগে জালিয়াতি করে ছাড়িয়ে নিয়ে যায় একটি চক্র।

জালিয়াতির মাধ্যমে শুল্ক কর্মকর্তার আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ২২টি কনটেইনার সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল চার বছর আগে। কিন্তু সেসব কনটেইনারে কী ধরনের পণ্য ছিল, সেটা আজ পর্যন্ত বের করতে পারেনি তদন্তকারী সংস্থাগুলো।

এ ঘটনায় ৩৫টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ২১টি তদন্ত করছে সিআইডি। ১৪টির তদন্ত করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুই সংস্থা এখন পর্যন্ত কনটেইনারে কী পণ্য ছিল, ও সেগুলো সরিয়ে কোথায় নেওয়া হয়েছে, সেটা বের করতে পারেনি।

সিআইডি বলছে, কনটেইনারগুলো বন্দর থেকে সরিয়ে নিতে আন্তদেশীয় চক্র কাজ করেছে। তারা ১১৬টি চালান ছাড় করিয়ে কনটেইনারগুলোয় বন্দর থেকে নিয়ে গেছে। চক্রের ৫৪ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঘোষণা অনুযায়ী, পণ্য আমদানি না করার অভিযোগে চট্টগ্রাম শুল্ক বিভাগ, শুল্ক গোয়েন্দা ও সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (সিআইইউ) ২০১৮ সালের শুরুতে ওই কনটেইনারগুলো আটকে দেয়। এরপর ২০১৮ সালের ১৯ এপ্রিল থেকে ২৬ সেপ্টেম্বরের মধ্যে জালিয়াতি করে ওই ২২টি কনটেইনার বন্দর থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়।

এ ঘটনায় ২০১৯ সালের ১৬ জানুয়ারি রমনা থানায় ২১টি মামলা করে শুল্ক কর্তৃপক্ষ। মামলাগুলোর তদন্তের দায়িত্ব পায় সিআইডি। ‍পরে দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের নির্দেশে মামলাগুলোর তদন্তভার দুদকের কাছে হস্তান্তর হয়। অনুসন্ধানের পর চলতি বছরের মার্চে দুদক এ ঘটনায় আরও ১৪টি মামলা করে। এরপর গত এপ্রিলে ঢাকার রমনা থানায় ২১টি মামলা সিআইডিকে তদন্ত করার জন্য আদেশ দেন ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালত। এরপর সিআইডি আবার তদন্ত শুরু করে। মামলাগুলোর তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে সাতজন অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপারকে নিয়োগ দিয়েছে সংস্থাটি।

সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার (গণমাধ্যম) আজাদ রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মামলাগুলোর তদন্ত খুব দ্রুতই শেষ করে প্রতিবেদন দেওয়া হবে।

তদন্তসংশ্লিষ্ট সিআইডির সূত্র বলছে, কারখানার যন্ত্রপাতি, পোশাক তৈরির সরঞ্জামসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানির ঘোষণা দিয়ে ব্যাংকে ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয়েছিল ১৪টি প্রতিষ্ঠানের নামে। এরপর পাঁচ দেশ থেকে ২২টি কনটেইনার আসে। ঘোষণা অনুযায়ী, বিল অব লেডিং (অর্থাৎ কনটেইনারের সঙ্গে থাকা ভাউচার) পাঠায় তারা। কিন্তু গোয়েন্দা তথ্য ছিল যে ঘোষণা অনুযায়ী পণ্য আনা হয়নি। এ কারণে কনটেইনারগুলো সিল করেছিল শুল্ক কর্তৃপক্ষ। সেগুলো প্রায় তিন মাস বন্দরে পড়ে ছিল। কিন্তু সেই সময় সংশ্লিষ্ট কোনো সংস্থা কনটেইনারগুলো পরিদর্শন করেনি। যে কারণে কনটেইনারের ভেতরে আসলে কী ধরনের পণ্য ছিল, তার রহস্য এখনো উদ্‌ঘাটন করা যায়নি।

জানা যায়, শুল্ক গোয়েন্দারা ২০১৮ সালের ১৯ এপ্রিল থেকে ২৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনা পর্যালোচনা করে জালিয়াতির বিষয়টি টের পান। এরপর ২০১৯ সালের ১৬ জানুয়ারি ঢাকার রমনা থানায় প্রথম মামলা করেন শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের তৎকালীন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন।

তিনি বর্তমানে চট্টগ্রাম কাস্টমসে কর্মরত। এরপর ২০১৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর রমনা থানায় আরও ২০টি মামলা করেন তৎকালীন আরেক

সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা আরিফ হোসেন। তিনি বর্তমানে কাস্টম, এক্সসাইজ ও ভ্যাটের ঢাকা পশ্চিমে কর্মরত আছেন।

সিআইডির তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, মামলাগুলো করা হয়েছিল মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে। সে সময় শুল্ক গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছিল, যাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে সেই চক্রটি ২০১৬ সালের ২ সেপ্টেম্বর থেকে সর্বশেষ ঘটনা পর্যন্ত প্রায় ৪ হাজার বার জালিয়াতির মাধ্যমে শুল্ক বিভাগের দুজন রাজস্ব কর্মকর্তার আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার এবং কাগজপত্র জাল করে মালামাল ছাড়িয়ে নিয়েছে।

এর মধ্যে একজন রাজস্ব কর্মকর্তা হলেন মহিবুল ইসলাম। তিনি ২০১৩ সালের ২২ জানুয়ারি থেকে ২০১৪ সালের ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে কর্মরত ছিলেন। আরেক রাজস্ব কর্মকর্তা ফজলুল হক অবসরে ছিলেন। দুজনই চট্টগ্রাম বন্দর থেকে চলে যাওয়ার সময় তাঁদের আইডি ও পাসওয়ার্ড বন্ধ করার আবেদন দিয়ে যান। রহস্যজনক কারণে সেগুলো বন্ধ করা হয়নি।

এদিকে সিআইডির সূত্রগুলো বলছে, এ ঘটনায় মানি লন্ডারিং আইনে করা মামলার শুরুতে ত্রুটি ছিল। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিধিমালা-২০১৯–এর ৩১ নম্বর বিধিতে বলা হয়েছে প্রাথমিক পর্যালোচনা বা অনুসন্ধানের পর মামলা দায়েরের কথা। এরপর মামলার তদন্ত এবং আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল। কিন্তু এ ক্ষেত্রে প্রাথমিক পর্যালোচনা বা অনুসন্ধান না করেই মামলা করা হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার দুই বাদীর একজন আরিফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, অনেক আগের কথা, এখন তাঁর কিছু মনে নেই। আরেক বাদী আনোয়ার হোসেন দাবি করেন, অনুসন্ধান করেই মামলা করা হয়েছিল।